কলকাতার এক-দেড় শতক আগে থেকে বড়দিন পালন করছে হুগলি

২০ ডিসেম্বর, ১৬৮৬ সাল। জোব চার্ণক তখন মোঘলদের তাড়া খেয়ে হুগলি ছেড়ে পালাচ্ছেন। বালেশ্বর যাবেন। পথে আশ্রয় নিলেন সুতানুটিতে, সুতানুটি তখন জঙ্গল ঘেরা অল্প কিছু দোকান নিয়ে বসা এক হাট মাত্র। গা ঢাকা দিয়ে ক'দিন কেটে গেল আর দেখতে দেখতে ক্রিসমাস চলে এল, সেবারই কলকাতায় প্রথমবারের জন্যে ক্রিসমাস উদযাপিত হল। তখনও কলকাতা গড়ে ওঠেনি।

গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলি? হুগলিতে একে একে এসেছিল দিনেমার, ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান, পর্তুগিজেরা। তাদের হাত ধরেই বড়োদিন এসেছিল গঙ্গা তীরের জেলায়। সাঁতগাও অর্থাৎ সপ্তগ্রাম ছিল বাণিজ্যের ঘাঁটি। কুঁড়েঘর নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রামকে পর্তুগিজরাই শহর বানিয়েছিল। ১৫৫৭ নাগাদ পর্তুগিজরা পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য (অনুষ্ঠানিকভাবে বলা চলে) প্রথম হুগলিতে আসে, যদিও ভারত ভূ-খণ্ডে ভাস্কো দা গামার পা পড়েছিল আরও বছর পঞ্চাশ আগে। হুগলিতে পর্তুগিজের ব্যবসা শুরু ১৫৩০ থেকে, ১৫৩৭-এ সাম্প্রায়ো নামে এক পর্তুগিজ হুগলিতে জমি কেনেন। আদপে সরস্বতী নদী সরে যাওয়ায় নতুন একটা নদী বন্দর গড়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তখনই বাছা হয় ভাগীরথীকে। পর্তুগিজরাই বন্দর গড়ে। সেটাই সাতগাঁও বা সপ্তগ্রাম, পোর্তো পেকুয়েনোর। জি.বারোজের আঁকা ১৫৫০ সালের মানচিত্রে সপ্তগ্রামের উল্লেখ রয়েছে।

হুগলি জেলায় পর্তুগিজদের আধিপত্য বিস্তারের তিনটি ধাপ রয়েছে, প্রথম ধাপ ছিল সাতগাঁওয়ে বসতি স্থাপন। নেপথ্যে ছিলেন আফোনসো ডা মেলো। ভাসকো পেরেজ ডা সাম্প্রায়োকে অনেক ঐতিহাসিকই মান্যতা দেননি। দ্বিতীয় ধাপে বসতি গড়ে ওঠে হুগলি সদরে, সময়টা ১৫৭০-'৮০-র আশেপাশে। আকবরের 'গ্রিন সিগন্যাল' নিয়ে তাভারেজ বসতি গড়েন। তৃতীয় ধাপে পর্তুগিজরা জাঁকিয়ে বসেন ব্যান্ডেল। সময়টা ১৬৩৩ সাল। যদিও লঙ সাহেব লিখেছেন অন্যকথা। তাঁর মতে, ১৫৩৮-র পর পর্তুগিজরা ব্যান্ডেলে জাঁকিয়ে বসতে আরম্ভ করেছিল।

শ্রীরামপুর ছিল ডেনিসদের কলোনি। গঙ্গার পশ্চিম পারে ডেনিসদের বহু স্থাপত্য সেই ইতিহাস আজও বহন করে। ডেনিস গভর্নর হাউস, ডেনিস টাভার্ন, শ্রীরামপুর কলেজ, উইলিয়াম কেরীর সমাধি, সেন্ট ওলাভ চার্চ নিয়ে চারশো বছরের ইতিহাস বহন করছে ফ্রেডরিকনগর শ্রীরামপুর শহর। সেই অঞ্চলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে বড়দিন পালিত হত। ব্যান্ডেল চার্চ ছিল কেন্দ্র বিন্দুতে। চুঁচুড়ায় আর্মনিয়ানরা আবার ৬ জানুয়ারি বড়দিন পালন করতেন।

চুঁচুড়াতেও ডাচরা তৈরি করেছিল নিজেদের চার্চ। হুগলি নদীর তীরেই ছিল ডাচদের চার্চ, পরবর্তীকালে ১৭৪৪ সালে এই চার্চের মিনার নির্মাণ করেন স্যার আলবার্ট সিচারম্যান। ১৭৬৮ সালে নভেম্বরে চার্চটির বাইরের কাঠামো পুনর্নির্মাণ করেন স্যার জর্জ লুই ভার্নেট। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৮৬৪ সালের ঘূর্ণিঝড়ে চার্চের ঘন্টাঘড়ি ভেঙে পড়ে। তিনশো, চারশো বছর ধরে ক্রিসমাস পালিত হচ্ছে গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলিতে। সেজে উঠত পথঘাট। রাস্তা সেজে উঠত। খাওয়া-দাওয়া অর্থাৎ সাহেবদের বাড়িতে ভোজসভা বসত। দেশীয়দের অংশগ্রহণ থাকত। ভবনগুলোও সাজানো হত। চার্চে প্রার্থনা চলত। আজও চলছে প্রার্থনা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...