বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোপাল ভট্ট গোস্বামী। চৈতন্য মহাপ্রভুর পরে যিনি বৈষ্ণব সমাজের হাল ধরে রেখেছিলেন নিজের হাতে। মহাপ্রভুর পরেই ছিল তাঁর আসন, এই গোপাল ভট্ট গোস্বামীর কাতর অনুনয়েই শালগ্রাম নিয়েছিলেন জীবন্ত রূপ! অনেকেই জানেন না সেই অলৌকিক কাহিনি! কীভাবেই বা গোপাল ভট্ট হয়ে উঠলেন মহাপ্রভুর পরে বৃন্দাবনের সর্বময় কর্তা? আজকের নিবন্ধে বলব সেই কাহিনি।
শ্রীরঙ্গম নামের একটি স্থানে বেঙ্কটভট্ট নামের একজন সজ্জন ব্যক্তি থাকতেন, তিনি অত্যন্ত ভক্তি পরায়ণ ছিলেন। দেবদেবীর প্রতি তার যেমন অসম্ভব ভক্তি ছিল তেমনি তাঁর স্ত্রীও ছিলেন তার যোগ্য সহধর্মিনী। তাই গৃহে আরাধ্য দেবতার পুজো ও নিত্যদিন ধর্মানুষ্ঠান করেই সেই ব্রাহ্মণ দম্পতির দিন কাটত! এরপর ১৫০০ সালে তাদের ঘর আলো করে জন্মায় তাদের পুত্র সন্তান গোপাল। বৃন্দাবনের গিরিধারীলালই যেন গোপালরূপে তাদের ঘরে এসেছে এই চিন্তা করে পুত্রের নাম গোপাল রেখেছিলেন বেঙ্কট ভট্ট।
ওদিকে গোপালের জন্ম হওয়ার পর যেমন তাদের পরিবারের মধ্যে আনন্দের আমেজ তৈরি হয়, তেমন ছোট্ট শিশু গোপালের মধ্যেই নানানরকম দিব্য ভাব প্রকাশ পেতে শুরু করে। সকলেই তার দিব্য ভাব এবং লক্ষণ সমূহ দেখে বুঝতে পারলেন যে এমন একটা সময় আসবে যেদিন এই গোপাল একজন সাধক মহাপুরুষ হয়ে উঠবেন। ছোট থেকে গোপাল যত বড় হতে থাকল তত তার দেবতার প্রতি ভক্তি, নির্জনতার প্রতি আসক্তি ও ধর্মশাস্ত্র পাঠের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখা দিল। প্রতিনিয়ত সে যেন এক নতুন আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান করতে থাকে, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার মনের মধ্যে তৈরি হয়।
ওদিকে তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। তিনি তীর্থ ভ্রমণ করতে করতে এসে উপস্থিত হন শ্রীরঙ্গমে। অতিথিপরায়ণ বেঙ্কট ভট্ট পরম আগ্রহ ও সম্মানের সঙ্গে মহাপ্রভুকে নিজের বাড়িতে স্থান দেন, এখানেই মহাপ্রভু চার মাস কাল থেকেছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব বেঙ্কটভট্টের পুত্র গোপালকে দেখেই বুঝে যান, এই গোপাল কোনও সাধারণ ছেলে নয়, তার ভিতর এক ঐশী শক্তি আছে। তিনি তখন গোপালের মনের ভক্তি ভাবকে আরও গভীরতর করতে তাকে হরিনাম মহামন্ত্র দান করলেন। মহাপ্রভু তীর্থ পরিক্রমায় বেড়িয়ে পড়ার পর গোপালভট্টের শিক্ষা ও সাধনা শুরু হল।
চৈতন্যদেব নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন বেঙ্কট ভট্ট যেন ছেলেকে পন্ডিত করে তোলেন। তাই পিতার তত্ত্বাবধানেই গোপাল শাস্ত্র অধ্যায়ন শুরু হয়। মহাপ্রভু আরও বলে গিয়েছিলেন, বিয়ে না করে বাবা-মায়ের সেবা করে যেতে ও তারপর বৃন্দাবনে গিয়ে সাধনা করতে। চৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী গোপাল নিজের জীবন চালনা করেন এবং এইভাবেই কেটে যায় কুড়ি বছর তারপর বেঙ্কট ভট্ট ও তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে গোপালের সাংসারিক বন্ধন পুরোপুরি কেটে যায়। এরপর আস্তে আস্তে বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ কমে যায় গোপালভট্টেরও। তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান বৃন্দাবন ধামে।
বৃন্দাবনের রূপ ও সনাতন গোস্বামীর কাছে গিয়ে ওঠেন গোপাল ভট্ট। এই দুই বৈষ্ণব সাদরে গ্রহণ করলেন গোপাল ভট্টকে। ওদিকে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে গোপালের আসার সংবাদ দেওয়া হল। গোপাল ভেবেছিলেন মহাপ্রভু হয়ত তাকে ডেকে পাঠাবেন আর সে ক্ষেত্রে বহু আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের সুযোগ ঘটবে। কিন্তু মহাপ্রভু তাকে ডেকে পাঠালেন না , কিন্তু তার কাষ্ঠাসন, ডোর , কৌপিন, বহির্ভাস পাঠিয়ে দিলেন গোপাল ভট্টের জন্য। এইসব জিনিস পাঠানোর ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন রূপ ও সনাতন গোস্বামী। নিজের আসন পাঠিয়ে প্রভু আসলে গোপালকেই তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন!
মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী গোপালই এখন বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সমাজের সর্বময় কর্তা। এরপর সকলের ইচ্ছা ও ঐকান্তিক আগ্রহে নিজেকে মহাপ্রভুর প্রতিনিধিজ্ঞানে গোপালভট্ট উপবেশন করলেন সেই পরম পবিত্র আসনে। মহাপ্রভু নিজের হাতে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রূপ, সনাতনকে! সেই চিঠিতে লেখা ছিল গোপালকে যেন ভাই হিসেবে সমাদর করা হয়। গোপাল মহাপ্রভুর সেই চিঠি মাথায় বারবার ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন, 'ভক্তের প্রতি প্রভুর এত কৃপা? এই আনন্দ আমি কোথায় রাখব? প্রভু আমাকে নিজের আসন বসন পাঠিয়ে প্রকাশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন, অন্তরঙ্গ বলে! আমার এই আনন্দ রাখবার জায়গা কই?' এরপর
বৃন্দাবনে ভজন সাধন ও শালগ্রাম শিলার সেবা করেই গোপাল ভট্টর দিন কাটতে লাগল। গোপাল বৃন্দাবনে আসার অল্প কিছুকাল পরেই মহাপ্রভুর দেহাবসান ঘটে ও এরফলে ভক্তরা শোকে আকুল হয়ে পড়েন।
মহাপ্রভুর দেহান্তের পর এই কঠিন সময়ে রূপ , সনাতন ও গোপাল এই তিনজন শক্ত হাতে হাল ধরলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের। তারা তিনজনে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় একসাথে আলোচনা করতেন এবং এইভাবেই গোটা বৈষ্ণব সমাজকে পরিচালনা করতেন। মহাপ্রভুর পরে কোনও ব্যক্তিকে দীক্ষাদানের দায়িত্ব গোপাল ভট্টের উপর এসে পড়ে। কারণ স্বয়ং মহাপ্রভু তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আসন পাঠিয়েছিলেন, তাই তিনিই দীক্ষা দান করতেন।
বৃন্দাবনে মাঝেমাঝেই অনেক ধনী ব্যক্তি ভগবানের মন্দিরও বিগ্রহ দর্শন করতে আসতেন ও তারা প্রচুর দান ধ্যান করতেন, একবার এক ধনী ভক্ত সাধুদের বিগ্রহ সেবা দেখে তাদের দেবতাদের জন্য অনেক দামী কাপড় , অলংকার দান করলেন। এই ধনী ব্যক্তি গোপালভট্টের শালগ্রামের জন্যও বস্ত্র ,অলংকার দান করেন। গোপাল ভট্টের এইসব বস্ত্র অলংকার দেখে মনে বড় দুঃখ হয়! তিনি ভাবেন, হায়রে আমার ঠাকুরের হাত-পা নেই! যদি থাকত কতই না ভালো হত! তাকে মনের আনন্দে বস্ত্র ও অলংকার পরাতাম। মনের মধ্যে এই দুঃখ নিয়ে গোপালভট্ট সেদিন শালগ্রামের সেবা করেন ও মনে মনে প্রার্থনা করেন, প্রভু এই বস্ত্র,এই অলংকার কি তোমার অঙ্গে শোভা পাবে না? তোমার ভুবনমোহন রূপ দেখে কি আমার জীবন ধন্য হবে না?
এরপর পূজা অর্চনা সেরে ও প্রসাদ গ্রহণ করে গোপাল ভট্ট শয়ন করলেন, সেইদিন রাত্রিবেলায় তিনি স্বপ্নে দেখেন তার শালগ্রাম দেবতার মূর্তি ধারণ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। জীবন্ত সেই মূর্তি! ভগবান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ও মধুর হাসি হাসছেন! এই আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে হঠাৎই গোপালভট্টের ঘুম ভেঙে গেল। এরপর সকালে তিনি স্নান করে পুজোর ঘরে গিয়েই থমকে গেলেন! স্বপ্ন নয়, সত্যি তার শালগ্রাম শিলা দেবতার মূর্তি ধারণ করেছেন ও ভগবান নিজেই বস্ত্র ও অলংকার পরে নিয়েছেন! গোপালভট্ট আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন , তার ভগবান তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেছেন, তিনি এই বিগ্রহের নাম রাখলেন শ্রী রাধারমন। দিকে দিকে এই কথা ছড়িয়ে পড়ল, সকলে জানলো গোপাল ভট্টের মাহাত্ম্য এবং তার আরাধ্য শালগ্রামের মাহাত্ম্য।
১৫৮৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে এই মহাসাধকের দেহাবসান ঘটে। তবে গোপাল ভট্টের আরাধ্য শ্রীরাধারমনের বিগ্রহ আজও বৃন্দাবনে বিরাজ করছেন! ভট্ট গোস্বামী তার প্রিয় শিষ্য গোপীনাথ দাসকে বিগ্রহ সেবার ভার দিয়েছিলেন আজও বৃন্দাবন ধামে শ্রী রাধারমনের সেবা কার্যে রয়েছেন গোপীনাথের বংশধররা।