ফুলটি আসলে ‘চাঁপা’ প্রজাতির সদস্য, কিন্তু এ-গাছের পাতার আকার সাপের ফনার মতো দেখতে হওয়ায়; সকলে একে ‘নাগচম্পা’ বলেই ডাকে। কেউ কেউ আবার তাকে ‘প্রেমনলিনী’ বা ‘বৃন্দাবন চাঁপা’ নামেও ডেকে থাকেন। কেন ডাকেন, জানা নেই। এগুলো ততটা প্রচলিত নামও নয়। এই গাছের ফুলের রঙ দুধের মতো সাদা। থোকায় ফোটে। তেমন সুগন্ধ নেই। তবে থোকা থোকা অজস্র অফুরান শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্যে এই ফুল বাগান একেবারে আলো করে রাখে। সবচেয়ে বড় কথা, নিতান্তই অল্প পরিচর্যায় অল্প খাবারের বিনিময়ে এই গাছ প্রায় সারা বছর অজস্র ফুল দিয়ে থাকে। শুধুমাত্র প্রচণ্ড শীতের মাস দুই এই গাছ বিশ্রাম নেয়। কোন কোন গাছ সামান্য ফুল দেয় এই বিশ্রামের সময়, কোন কোন গাছ একেবারেই দেয় না।
নাগচম্পার একটা প্রবণতা হল, তরতরিয়ে বেড়ে যাওয়া। সামান্য যত্নেই সে অল্পদিনে সাত-আট ফুট লম্বা হয়ে যায়। তবে এই গাছ কিন্তু খুব সুন্দরভাবে ছাদ বা ব্যালকনিবাগানের টবে করা যায়। এ-ক্ষেত্রে শুধু গাছের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রচুর ফুল আদায় করে নেওয়ার সহজ কিছু ‘ট্রিকস’ আপনাকে অ্যাপ্লাই করতে হবে। সেই ‘ট্রিকস’ গুলো কী, তাই নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। আসুন আলোচনা শুরু করি প্রথম চারা কেনা থেকেঃ
প্রথমবার গাছ বসানোর জন্য কেমন চারা আনবেন?
বছরের যে-কোন সময়ই নাগচম্পা গাছের চারা টবে বসানো যায়। তবে শীতে এই গাছের বৃদ্ধি খুব কম হয় বলে ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ অব্দি এর চারা বসানোর আদর্শ সময়। এই গাছের চারা কিনতে গিয়ে একটি মাত্র গাছ রয়েছে, একটাও ডাল নেই—এমন চারা কিনবেন না। অমন চারা বাগে এনে মনের মতো শেপ দিতে অহেতুক সময় লাগে। তাই কমপক্ষে দুটি বা তার বেশি ডালযুক্ত অন্তত দেড় ফুট উচ্চতার সুস্থ, সতেজ ও নীরোগ চারা কিনবেন। বাড়িতে চারা এনে কম করেও সাতদিন রেখে তাকে বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেবেন, তারপর তার রি-পটিং করবেন।
উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?
সব ধরণের মাটিতেই নাগচম্পা করা যায়। তবে জৈবসারসমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি এই গাছের জন্য একেবারে আদর্শ। এই মাটি তৈরি করতে দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, এক ভাগ সাদা মিহি বালি, দেড় ভাগ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে নেবেন। অবশ্য বাড়িতে পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে আগের পরিমাণ জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, এক চামচ নিমখোল, এক চা-চামচ গুঁড়ো ফসফেট, এক চামচ শিংকুচি বা হাড়গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নেবেন। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রি-পটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।
কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?
নাগচম্পা দীর্ঘস্থায়ী গাছ হলেও একে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় টবে দিতে হয়, প্রথমেই বড় টবে নয়। তাতে গাছের বৃদ্ধি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দেড় ফুটের গাছ আরামসে আট ইঞ্চি টবে এবং চারার উচ্চতা তার চেয়ে বেশি হলে দশ ইঞ্চি টবে বসাবেন। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর ফুল সানলাইটে দেবেন।
কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?
রোদঃ নাগচম্পা রোদ খুব ভালোবাসে। ডিরেক্ট সানলাইট কমপক্ষে চার ঘন্টা তাকে দিতেই হবে। এর চেয়ে কম রোদে এই গাছ একেবারেই ভালো ফুল দেয় না। সারাদিনের রোদ খাওয়ানোর সুবিধে থাকলে, এই গাছ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় এবং প্রচুর পরিমাণে ফুল দেয়।
জলঃ বর্ষার সময় খেয়াল রাখবেন, গাছের গোড়ায় যেন একেবারেই জল না-জমে। জমা জল গোড়ায় পচন ধরায়। তবে এই গাছ খরাসহিষ্ণু গাছ। তাই টবের ওপরের মাটি শুকিয়ে এসেছে—এমন অবস্থা দেখলে তখন এই গাছে জল দেবেন; নতুবা দেবার দরকার নেই।
অন্যান্য খাবারঃ নাগচম্পা গাছে খুব বেশি খাবারের প্রয়োজন হয় না। মাসে দু’বার হয় জৈব, নয়তো রাসায়নিক কিংবা দুটোই পনেরো পনেরো দিনের গ্যাপে অল্টার করে দেবেন। কীভাবে সেই খাবার দেবেন, সেটাই এবার বলছিঃ
জৈব পদ্ধতিঃ পনেরো দিন পর পর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন অথবা বাদাম খোল একদিন পচিয়ে দেবেন। এ-ক্ষেত্রে হাফ লিটার জলে এক মুঠো খোল দিয়ে পচাবেন। তারপর সেই পচানো খোলজলের সঙ্গে আরও তিন লিটার জল মিশিয়ে সেই জল যতটা প্রয়োজন গাছের টবে দেবেন। অথবা পাঁচশো গ্রামের মতো সবজি ও কলার খোসা এক লিটার জলে পনেরো দিন পচিয়ে ছাঁকনি দিয়ে তরল অংশটা ভালো করে ছেঁকে নেবেন। তারপর ঐ তরলের সঙ্গে আরও ছ’লিটার জল মিশিয়ে গাছে দেবেন।
রাসায়নিক পদ্ধতিঃ চা-চামচের তিন ভাগের দু’ভাগ অথবা যত ইঞ্চির টব ততগুলো ডিএপি’র দানা বারো থেকে পনেরো দিন অন্তর টবের আধভেজা মাটিতে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিয়ে সেই মাটি খুঁচিয়ে দেবেন।
প্রচুর ফুল পেতে বিশেষ ‘ট্রিকস” বা পরিচর্যা কোনগুলো?
নাগচম্পা ফুলের মরসুম এলে একবার ফুল দিতে শুরু করলে সে কিন্তু ফুল দেওয়া থামায় না। একটা ডালের ফুল ফুটে গেলে গাছ স্বাভাবিকভাবে নিজেই আর একটা ডালের জন্ম দিয়ে ফুল ফোটায়। কিন্তু এতে একটা গ্যাপ তৈরি হয়, সেই ডাল ফুল দেওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠার মাঝের কিছুদিন ফুল পাওয়া যায় না; গাছকে এই বিরামের অবসর না-দিয়ে কী-করে বেশি বেশি ফুল আদায় করে নেওয়া যায়, সেটাই এখন বলছিঃ
ক. প্রচুর ফুল পেতে প্রথমেই দেখতে হবে, গাছে রোদের যেন কিছুতেই ঘাটতি না-হয়। প্রচুর রোদ পেলে এই গাছ প্রচুর নতুন শাখার জন্ম দিয়ে প্রচুর ফুল ফোটাতে উৎসাহ পায়।
খ. দিন কুড়ি অন্তর কলার খোসা পাঁচ থেকে সাতদিন পচিয়ে সেই জলের সঙ্গে আরও ছ’গুণ সাধারণ জল মিশিয়ে সেই মিশ্রিত জল গাছে দিতে হবে। এটা সম্ভব না-হলে, ঐ একই সময় মেন্টেইন করে টব প্রতি আধ চা-চামচ লাল পটাশ গাছের গোড়া থেকে দূরে আধভেজা মাটিতে ছড়িয়ে মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। নিয়মিত এই পরিচর্যায় নিশ্চিতভাবে আপনার গাছে নতুন শখা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফুলের পরিমাণও কয়েকগুণ বাড়বে।
গ. এ-গাছের ডালের আগাতেই শুধুমাত্র থোকাভর্তি কুঁড়ি আসে। তাই এই গাছ থেকে বেশি ফুল পেতে স্বাভাবিকভাবেই ডালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ-কারণেই প্রথমেই বলেছি নতুন চারা আনার সময় বেশি ডাল আছে কি না দেখে আনতে। এই ডালগুলোর ডগা ছেঁটে আরও ডালের সংখ্যা বাড়িয়ে গাছকে ঝাঁকড়া করতে হবে। তারপর শুরু করতে হবে ফুল নেওয়া। ফুল নেওয়ার এই আগের কাজগুলো চারা বসানোর দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে সেরে ফেলবেন। একবার ফুল নিতে শুরু করলে গাছকে আর ওভাবে ডিস্টার্ব করবেন না, তখন শুধুমাত্র সব ফুল ফোটার পর রয়ে যাওয়া বৃতিদণ্ডটি কেটে কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। তখন এতেই গাছ নিজের মতো করে শাখার সংখ্যা বাড়িয়ে যাবে এবং অফুরান ফুল দিয়ে যাবে।
ঘ. বাড়িতে পুরনো গাছ থাকলে এই মুহূর্তে বা চলতি ফুলের মরসুমে হার্ডপ্রুনিং করবেন না, তাতে পরবর্তী কুঁড়ি আসার সময় অনেক পিছিয়ে যাবে। হার্ডপ্রুনিং-এর জন্য উপযুক্ত সময় আছে, আপাতত তার জন্য অপেক্ষা করুন। আর উপযুক্ত খাবার দেবার পাশপাশি ‘ক’ ও ‘খ’-এই দুটো পয়েন্ট মাথায় রেখে শুধুমাত্র ফুল ফোটার পর বৃতিদণ্ড কেটে ফেলে এবং নতুন বেরিয়ে আসা দু’একটি শাখার আগা সামান্য ছেঁটে গাছকে নতুন শাখার জন্ম দিতে উৎসাহ দান করুন।
গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর উপায় কী?
নাগচম্পার তেমন কোন রোগবালাই নেই। এদিক থেকে সে একেবারে ঝাঞ্ঝাটবিহীন লক্ষ্মী গাছ।
কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?
নাগচম্পার ক্ষেত্রে হার্ডপ্রুনিং ও রি-পটিং-এর আদর্শ সময় শীতের শেষদিক অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ অব্দি। হার্ডপ্রুনিং বছরে একবার অবশ্যই করবেন; রি-পটিং করবেন শেকড় টবের মাটির ওপরের দিকে উঠে এলে। হার্ডপ্রুনিং করার সময় মাটি থেকে অন্তত এক ফুট কাণ্ড অবশ্যই রাখবেন। এ-ক্ষেত্রে সমস্ত ডাল ছেঁটে কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। তারপর পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ শেকড় ছেঁটে আগের চেয়ে এক সাইজ বড় টবে রি-পটিং করবেন। টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে আদর্শ মাটি দিয়ে তার ওপর এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর ছাঁটাই করা গাছটা বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর টবে কানাভর্তি জল দিয়ে এবং পাঁচ-ছ’দিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।
নতুন চারা তৈরি করবেন কীভাবে?
আঙুল-মোটা শক্ত সাদাটে ডাল থেকে নাগচম্পার চারা খুব সহজেই চারা তৈরি করে নেওয়া যায়। রুট-হরমোন ছাড়াই কাটা ডাল দোআঁশ বা বেলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটি সবসময় হালকা ভেজা ভেজা রাখবেন। তা থেকে নতুন চারা পেতে শীতকালে দেড় থেকে দু’মাস সময় লাগে; অন্যান্য সময় পঁচিশ থেকে তিরিশ দিন।