শীত মানেই মেলা শাক; অর্থাৎ কিনা শাকের মেলা। এই তো ক’দিন আগেই ভূতচতুর্দশী উপলক্ষ্যে চোদ্দ রকমের শাক খাওয়ার ফিরিস্তি দিয়ে বঙ্গদেশে শীত আলতো পায়ে এসে পড়েছেন। যদিও আজকাল সবসময়ই যে-কোন শাকসবজি অল্পবিস্তর বাজারে পাওয়া যায় বটে; তবে ঋতুর শাক ঋতুতে খাওয়ার মজাই আলাদা। অরিজিনাল স্বাদটা পাওয়া যায়। তাছাড়া অন্যসময়ের চেয়ে শীতের বাজারে তারা বেশ সস্তা হয়ে ওঠে, মধ্যবিত্তের নিত্যদিনের বাজারের থলেতে দেদার তাদের ঠাঁই হবার সুযোগও ঘটে। ফলে, সাধ্যের মধ্যে সাধ মিটিয়ে খাওয়া যায়।
তবে এখানে একটা কথা বলি, যদি আপনার ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে কমপক্ষে ঘন্টাচারেক বেশ ভালো রোদ আসে, আর খানিকটা উদ্বৃত্ত জায়গা থাকে, তাহলে শাক, চাষ করে খাওয়াই ভালো। নির্বিষ শাক নিশ্চিন্তে খাওয়ার এটাই একমাত্র রাস্তা। কেননা, বাজারে গিয়ে আপনি, আমি কী চাই? চকচকে ঝকঝকে নধর শাক। চাষি-বিক্রেতাও তেমন শাকই বেচতে চায়। কেননা, গাছ নধর হয়ে চকচকে পাতা ছাড়তে ছাড়তে বেশ বড় হলে তবে সেই শাকের আঁটি ওজনে বেশি হয়। তাতে চাষি ও বিক্রেতার লাভ হয়।
কিন্তু পোকাদের এতদিন তো ঠেকিয়ে রাখা যায় না, তারা শাকের পাতা ঝাঁঝরা করে দিতে ক’দিনের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে তাদের ঠেকাতে শুরু থেকে সপ্তাহে একবার বা দু’বার নিয়ম করে বিষ দিয়ে যেতে হয়। সে পোকা লাগুক ছাই, না-লাগুক। আর বিষ একবার দিলে দিন পনেরো তার ক্ষতিকর প্রভাব থাকে, তাই এই সময় বিক্রি করা নীতিগতভাবে উচিত নয়। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে নীতির তোয়াক্কা করে কে! পরের ছেলে পরমানন্দ, যত ভোগে যায় ততই আনন্দ। আমার তো মুনাফা হচ্ছে রে বাপু! ব্যস, বিষ দেওয়ার পরদিন থেকেই দেদার বিক্রি চলে।
যেখানে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাই নেই, সেখানে নীতি সচেতনতা আসবে কোত্থেকে! বাজার থেকে কচি পালংশাক কিনে এনে বেশ ভালো করে ধুয়ে রান্না করেও তা থেকে কেবলই পেয়েছি গ্যামাক্সিনের মতো বিটকেল গন্ধ! উফ, বারকয়েক এটা হওয়ার পর পালংশাক বস্তুটাতেই আমার অরুচি ধরে গিয়েছিল; বছর দুই হল ছাদবাগানে চাষ করে অল্প অল্প করে খেয়ে রুচি ফিরিয়েছি। বাজারের লালশাকটারও একই অবস্থা, তার ওপর ওটাতে আজকাল কোন স্বাদ থাকে না। (যাক গে, আপনাদের মনে ভিত্তিহীন ভীতি তৈরি করা এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়; কাছ থেকে বাজারি চাষিদের কাণ্ডকারখানা দেখে আর নিজের অভিজ্ঞতা যা হয়েছে, তাই-ই আপনাদের কাছে শেয়ার করলাম। আমি একেবারেই সবজি বাজার বয়কট করতে বলছি না, সেটা সম্ভবও নয়; তবে সচেতন থেকে একটু দেখেশুনে কিনবেন। সেই সঙ্গে পারলে বা জায়গা থাকলে একটু চাষ করবেন। তখন কেনা আর ফলানো শাকের স্বাদের ফারাকটা বুঝতে পারবেন)।
শাক চাষের জন্য আহামরি বিরাট কিছু জায়গার দরকার নেই। টবে বা পলিব্যাগেই দেদার চাষ করা যাবে। এভাবে পালং, নটে, চাঁপা নটে, পুনকা, কলমি, লাল শাক, মুলো, পাট শাক, ধনে শাক খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। আমি লকডাউনের সময় থেকেই এভাবে আমার ছাদবাগানে শাক চাষ করে আসছি। অল্প অল্প করে কয়েক রকমের শাক চাষ করলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নানান ধরণের শাক খাওয়া যায়। একবার চাষ করলে অনেকদিন ধরে খাওয়া যায়। প্রতিটি শাকের বীজ আপনি বীজের দোকানে গিয়ে খুচরো হিসেবে নেবেন। প্যাকেট কেনার কোন দরকার নেই। ফালতু ফালতু অনেক বেশি দাম পড়ে যাবে। যে-ক’টা জাতের শাক আপনি বুনবেন প্রতিটি আলাদা আলাদা করে পাঁচ টাকায় যতটা হয়, ততটা করে দিতে বলবেন। শুধু কলমি শাকের বীজ নেবেন দশ টাকার। ব্যস, ওতেই আপনার প্রয়োজন মিটে যাবে। যেটুকু বীজ পাওয়া যাবে, তাতেই একাধিকবার করে বোনা যাবে। তবে বীজ বোনার আগে আসুন মাটি তৈরি করে নিইঃ
শাকের মাটি বেলে-দোআঁশ হতে হবে। নরম ও মোলায়েম হবে। তাই এক ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে এক ভাগ বালি এবং দু’ভাগ কমপক্ষে এক বছরের পুরনো পচা গোবর অথবা ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। চাইলে গোবর বা কম্পোস্ট আর একটু বেশি দিতে পারেন। কারণ, এটাই শাকের মেইন খাবার। এই যে মাটিটা তৈরি করলাম, এতে সব ধরণের শাক তৈরি করা যাবে। এই মাটি দশ-বারো ইঞ্চি চওড়া মুখের পলিব্যাগে তলার দিকে ছ’ থেকে সাত ইঞ্চি মাটি ভরবেন, তার বেশি মাটি শাক চাষে দেবার দরকার নেই। পলিব্যাগে জলনিকাশির জন্য তলায় চারদিকে সবমিলিয়ে খানআষ্টেক ফুটো করতে হবে। উপযুক্ত জলনিকাশি ব্যবস্থা রেখে প্লাস্টিকের চওড়ামুখ গামলা, বারো ইঞ্চির টব—এসবেও চাইলে শাক চাষ করতে পারেন।
শীতে, মানে এই নভেম্বরে আপনি পালং, পুনকা, কলমি, লাল শাক, চাঁপা নটে, মুলো আর ধনে—এই শাকগুলো বুনবেন। বীজগুলো কিনে এনে একদিন রোদ খাইয়ে ঠাণ্ডা করে নেবেন। আগের রাত্রে শুধু ধনে বীজ জলে ভিজিয়ে রাখবেন। অন্যগুলোতে সামান্য জলও লাগানোর দরকার নেই। পরদিন বোনার আগে জল থেকে ধনে বীজগুলো ভালো করে ছেঁকে নিতে হবে। এবার প্রতিটি জাতের শাক বোনার জন্য চার-পাঁচটা বারো ইঞ্চির টব বা সেম-সাইজের মুখযুক্ত পলিব্যাগে মাটি ভরে রেডি করে সেই মাটির ওপর খুব পাতলা করে বীজ বুনে দিয়ে তার ওপর আলতো করে মাটি বা কম্পোস্টের গুঁড়ো সুন্দর করে সমানভাবে ছড়িয়ে একটা হাফ ইঞ্চির লেয়ার বানিয়ে দিতে হবে। তার ওপর ঝারি দিয়ে বা হাত দিয়ে বৃষ্টির মতো করে জল ছিটিয়ে পুরো মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় টব বা পলিব্যাগগুলো ফুল সানলাইটে রেখে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, মাটি শুকিয়ে যেন না-যায়; শুকিয়ে এলেই ফের জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে আগের পদ্ধতিতেই। চার থেকে পাঁচদিনের মধ্যেই সব গাছের চারা বেরিয়ে যাবে। আগে প্রতিটি চারার খানচারেক করে পাতা মেলতে দিন, তারপর এক্সট্রা খাবার দেওয়া শুরু করবেন।
শাকের খাবার হিসেবে তখন তিন দিনের খোলপচা জল পাতলা করে সপ্তাহে একবার দিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে পারলে পনেরো দিনের সবজি, পেঁয়াজ, রসুন ও ডিমের খোসা পচানো জল পাতলা করে পরের সপ্তাহে দিতে পারেন। মানে, এটা এ-সপ্তাহে, তো ওটা ওই সপ্তাহে। এইভাবে দেবেন। দশদিন পর পর গাছের গোড়া বাঁচিয়ে পলিব্যাগ বা টব প্রতি দশ দানা করে ইউরিয়া দিয়ে যাবেন। মাসে একবার টব বা ব্যাগ প্রতি চার মুঠো করে গোবর বা কম্পোস্ট দিয়ে যাবেন। ব্যস, এর বেশি আর কিছু করার দরকার নেই। অন্য গাছে কোন পোকার আক্রমণ হবে না দোতলা ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে। শুধু পালং গাছে দেখবেন পাতা ফুটো করছে এক ধরণের লার্ভা পোকা। এরা রাত্রে বেরোয়। মাটিতে লুকিয়ে থাকে দিনে। বিষ দেবেন না, টব বা পলিব্যাগ খুঁজলেই এদের খুঁজে পাবেন। ধরে ধরে মেরে ফেলবেন। অবসরে রাত্রে গাছের কাছে গেলেও এদের পেয়ে যাবেন। চার-পাঁচটা টব বা ব্যাগ খুঁজে এদের মেরে ফেলাটা তেমন কোন হ্যাপাই নয়। আমি নিজে করি। কই, তেমন ঝঞ্ঝাট বলে তো মনে হয় না। এর সঙ্গে মাটিতে আগাছা দেখলেই তুলে ফেলে দেবেন। আর কিচ্ছু করতে হবে না।
এবার গাছ যখন শাক খাবার মতো হয়ে যাবে, তখন প্রয়োজনীয় শাক শুধু ছিঁড়ে বা কেটে নেবেন; কোন গাছই পুরো তুলে ফেলবেন না। যেমন, পালং, ধনে ও মুলোর শুধু পাতা তুলবেন। মাঝের দুটো কচি পাতা ও মাটিতে থাকা মূলটা রেখে বাকি পাতাগুলো তুলে খাবেন। কলমির গোড়া থেকে ইঞ্চি চারেক ওপরের অংশ রেখে বাকিটা কেটে খাবেন। পুনকা, চাঁপা নটে ও লাল শাকের তলার দিকের দুটো একটা পাতা রেখে ডগা তুলে তুলে খাবেন। এদের যত ডগা ভাঙবেন, তত এরা ঝাড় কাটবে। প্রথম প্রথম শাকের পরিমাণ কম হলেও যত দিন যাবে, যত এদের ঝাড় বাড়বে, আপনি তত বেশি শাক পাবেন। যে টব বা ব্যাগ থেকে শাক কাটিং করবেন, কাটিং-এর পর তাতে দশ দানা ইউরিয়া ছড়িয়ে জল দিয়ে দেবেন। এতে খুব তাড়াতাড়ি নতুন শাখা জন্মায়, নতুন পাতা জন্মায় এবং খুব দ্রুত বাড়ে। এই শাকগুলো এভাবেই পুরো শীতজুড়ে চুটিয়ে খেতে পারবেন। তবে কলমিটা থেকে যাবে সারা বছর। মুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো শীত শেষ হলে গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু সেমিসেডে রেখে দিলে এপ্রিল-মে পর্যন্ত শাক খাওয়া যায়।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বুনবেন গরমের শাক। পাট শাক ও নটে শাক। নটে বীজ যখন নেবেন, বলবেন, ঝাড় হয় এমন মিষ্টি নটের বীজ দিতে। কেননা, নটে অনেক রকমের হয়। যেভাবে শীতের শাক বুনেছিলেন, সেভাবেই চার-পাঁচটা টব বা পলিব্যাগে পাট শাক বুনবেন। এর পরিচর্যা অন্যদের মতোই। ডগার পাতা তুলে তুলে খেলে একবার চাষ করে মাস ছয়েক ধরে আরামসে শাক খাওয়া যায়।
নটের চাষ পদ্ধতি আলাদা। নটে চারা তৈরি করে রোপণ করতে হয়। প্রথমে একটা পলিব্যাগে বীজ ছিটিয়ে বুনে তার ওপর মাটি ঢাকা দিয়ে তৈরি করবেন খানকুড়ি চারা। তারপর চারাগুলো চার-পাঁচটি পাতা মেললে এবং গোড়া শক্ত হলে আলাদা আলাদা পলিব্যাগ বা টবে বসালেই হবে। এক কেজি মাটি ধরে এমন পলিব্যাগ এবং চার বা ছয় ইঞ্চি টবে আগের মতো মাটি তৈরি করে এক একটি টবে বা ব্যাগে একটি করে চারা বসাবেন। চারা ধরে গেলে আগে-বলা পদ্ধতিতে খাবার দেওয়া শুরু করবেন। গাছ সাত-আট ইঞ্চি হলেই নীচে চার ইঞ্চি রেখে ওপরের দিকটা কেটে নেবেন। কাটার পর টব প্রতি চার থেকে পাঁচ দানা ইউরিয়া দিয়ে জল দিয়ে দেবেন। অল্পদিনেই গাছ ঝাড় হবে খুব। তখন একই পদ্ধতিতে ডগা কেটে কেটে শাক হিসেবে খেতে থাকবেন। যখন দেখবেন গাছে ফুল চলে আসছে, তখন গাছ শুদ্ধু উপড়ে নিয়ে বিভিন্নভাবে রেঁধে খেতে শুরু করবেন। অন্যদিকে নতুন করে চারা ফেলুন। পুরনো নটে শেষ হতে হতে নতুন নটের চারা রোপণ করতে শুরু করে দিন। এভাবেই চলতে থাকুক আপনার নির্বিষ ও সুস্বাদু শাক চাষের নিরন্তর ধারা।।...