কবিতার জন্য সারা বিশ্বে বিশেষ একটি দিন

খ্রিস্ট্রপূর্ব চারশো অব্দের দার্শনিক প্লেটো তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোন স্থান দিতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন যোদ্ধা জনগণ, যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করবে। তিনি ভেবেছিলেন কবিদের পেলব প্রকৃতির সঙ্গে হাতের অস্ত্র যায় না। খ্রিস্ট্রীয় পনের শতকে টমাস মুরও যখন আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে ‘ইউটোপিয়া’ গ্রন্থটি লিখলেন, তখন প্লেটোর মতকে মান্যতা দিয়ে কবিদের সে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করলেন।

কিন্তু কবিরা একদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা শুধু দেবতার জয়গাথা লেখেন না, রাজাদের স্তুতিগাথা লেখেন না, পেলব চর্চায় নিছক প্রেমের জোয়ারে ভাসার কথা বলেন না; প্রয়োজনে তাঁরা কলমকে খরসান করে তুলতে পারেন। কবিতার পংক্তিকে করে তুলতে পারেন বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র। কবিতা দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমকে মিলিয়ে দিতে পারেন, ঘটাতে পারেন তমসার মাঝে সূর্যোদয়।

আমাদের বাংলার বুকে ইংরেজের শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, তাতে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ সাধারণের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়েছিল। বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’ দেশমাতৃকার জন্য সংগ্রামের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ অখণ্ড বাংলারক্ষার দাবিতে সাধারণকে পথে নামতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলার বিপ্লবীদের বুকে আগুন জ্বেলেছিল, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ কারারুদ্ধ সংগ্রামীদের শক্তি জুগিয়েছিল। সুকান্তের কবিতাও তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিল গভীরভাবে।

বাংলার বুকে ভাষা আন্দোলনে, তেভাগা আন্দোলনে, শ্রমিক আন্দোলনে শাসকের অত্যাচারে মালিকের অত্যাচারে যখনই মানুষের রক্ত ঝরেছে, অন্যায়ের পায়ে মানুষের মর্যাদা দলিত হয়েছে; তখনই কবিতা প্রতিবাদের স্বর হয়েছে, রুখে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হয়েছে।

আবার, যুগে যুগে কবির কলম যখনই শাসকের প্রতি তর্জনী তুলেছে, তাঁর কবিতার পংক্তি যখনই সাধারণের ক্লাছে প্রতিবাদের মন্ত্র হয়েছে; তখনই শাসক কবিকে হয় রুদ্ধ করেছে, নয় তাঁর সৃষ্টিকে নিষিদ্ধ করেছে।

সুতরাং, আদর্শ রাষ্ট্রে একজন অস্ত্রধারী সুশাসনকামী সৈনিকের চেয়ে একজন সৎ কবির স্থান কোন অংশেই কম নয়। কারণ, শুধু আগুন জ্বালালেই হয় না, তাকে ইন্ধন জুগিয়ে জ্বালিয়ে রাখার জন্যও কাউকে প্রয়োজন। সেই কাজটা করেন একজন সৎ কবি।

কবিতা কাজ কি শুধুই প্রতিবাদ করা? অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো?

শুধুই তা হবে কেন। মানুষ মানুষের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অন্তর ছুঁতে চায়। দর্শন ছুঁতে চায়। আবেগের অংশীদার হতে চায়। মননলোকের বিস্তার দেখতে চায়। ভাবতে চায়। ভাবাতে চায়। এ-সবই অতি সুন্দরভাবে করে কবিতা। একটি কবিতার বই খুলুন, দেখুন তার চরণে চরণে আপনার ভাবনারা কেমন ঘুঙুর হয়েছে…

কবিতা কেমন করে হয়?

যেমন করে একজনের সঙ্গে আর একজনের আলাপ হয়। ভাবনার বুকে ঢেউ উঠলে আবেগের পাত্রে যেটুকু রসময় হয়ে ধরা পড়ে, তাই কবিতা। প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রীরা তো বলেইছেন, রসময় কথা মানেই কবিতা। একটু বাঁক ঘুরেই মুখের ভাষাই কবিতা হয়ে উঠতে পারে। সেটা যখন হয়, তখন আমরা বলি, লোকটা কাব্যি করে কথা কইল।

কবিতা যে-কেউ লিখতে পারেন। শুধু তাঁর দেখার চোখ, রসবোধ আর জীবনবোধ থাকলেই হল। তথাকথিত শিক্ষা ছাড়াই শুধুমাত্র ঐ তিনটে গুণে প্রাচীনা মহিলারা যে ছেলেভুলানো ছড়াগুলো মুখে মুখে রচনা করেছিলেন, তা আজও বেঁচে থেকে কালজয়ী হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর সেই কবেই সামান্য দুটো মুখের কথা ব্যবহার করে ছড়া লিখে বালক রবীন্দ্রনাথের মনে চিরস্থায়ী দোলা দিয়েছিলেন। খুব সামান্য এবং সাধারণের মুখের কথাঃ

‘জল পড়ে

পাতা নড়ে।’

বোধ তৈরি হলে এমন হৃদয় দোলানো পংক্তি যে-কেউই লিখে ফেলতে পারেন। পারেন না কি? আমাদের বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ প্রখ্যাত গদ্যকারেরই লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছে কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই।

অবশ্য তারপরেও আটের দশকে রব উঠেছিল, ‘এত কবি কেন?’ আসলে নতুন কবিদের পদধ্বনি তখন প্রতিষ্ঠিত অনেক কবিরই পছন্দ হচ্ছিল না। তাঁরা জীবনানন্দের ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ আপ্তবাক্যে আস্থা রেখে আপামরের কাব্যসাধনাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেই স্রোতে হাঁটতে পারেননি। তিনি এর বহু আগে থেকেই বাংলা কাব্যসাহিত্যে ভগীরথের মতো নতুনদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’।

এবং আপামর সবাইকে পদ্যের প্রাঙ্গণে হাজির করতে তিনি একদা লিখেছিলেন, ‘বিশ্বাস করুন চাই না-করুন, কবিতা লেখা সত্যিই এমন-কিছু কঠিন কাণ্ড নয়। সে তুলনায় পদ্য লেখা আরও সহজ।’ আর তাই 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র পাতায় 'কবিকঙ্কণ' ছদ্মনামে তিনি খুলে ফেলেছিলেন ‘কবিতার ক্লাস’।

সেই ক্লাসে হাজির হয়েছিলেন কবি হতে আগ্রহী ও কবিতার রস পেতে আগ্রহীরা। এমনকি কবি শঙ্খ ঘোষ, প্রাবন্ধিক ভবতোষ দত্ত, ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনও বাদ যাননি। সেখানে শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে প্রাত্যহিক দৈনন্দিনজীবনের গদ্যময় হতচ্ছেদার শব্দমালাও যে পদ্যময় হয়ে উঠতে পারে, অত্যন্ত সরসভঙ্গিতে সেটা দেখিয়ে দিতে দিতে তিনি আমাদের কখন ডুবিয়ে দিয়েছিলেন ছন্দের মায়ায়; শিখিয়ে দিয়েছিলেন ছন্দের ঘর ও বাহির।

বোধের বেলাভূমিতে কবিতা আসলে জীবনদর্শনের ভাঙা আয়না। টুকরো টুকরো কাচে প্রতিফলিত সূর্য। তাদের জুড়তে পারলেই জীবন।

জীবন যদি সাহিত্য হয়, সাহিত্য পায় জীবন—তাহলে আর কী চাই!

প্লেটো যাই বলুন, মুর তাঁকে যতই মান্যতা দিন; রসিক মানুষ জানেন, জীবনে কবিতার স্থান কতখানি। বিশ শতকের শেষে এসে ইউনেস্কোও সেটা বুঝেছেন। তাই বিশ্বজুড়ে কবিতা লেখা, কবিতা পড়া, কবিতার বই ছাপা, কবিতার আবৃত্তি—এই সমস্ত কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দিতে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ২১ মার্চকে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। সেই অনুযায়ী বিশ্বময় ২০০০ সালের ২১ মার্চ প্রথম ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উদযাপিত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর এই উদযাপন চলছে আগামীর রাস্তা ধরে…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...