বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল ইতিহাস চর্চা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস বিশেষ করে রেনেসাঁস কালের কথা তাঁকে টানত। কেমন ছিল রামমোহন, দ্বারকানাথ, বা দেবেন ঠাকুরের কলকাতা সেসব নিয়ে ওপার কৌতুহল। তাই খবরের কাগজে ফুলটাইম চাকরি আর লেখালেখির চাপ সামলেও আগ্রহের বিষয় নিয়ে চর্চাটা লেগেই থাকত তাঁর। এক কালের সেই চর্চা থেকেই জন্ম নিল ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর মতো উপন্যাস।
ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে ফিরে দেখা অতীতকে। কীভাবে বদলেছে দেশ-সমাজ-মানুষ, এ যেন অনেকটা আয়নায় মুখ দেখার মতো। উপন্যাসের মুখবন্ধতে মেলে ধরে ছিলেন সেই ভাবনা।
কীভাবে জন্ম হল উপন্যাসের, সে কথা বলতে গিয়ে সুনীল বলেন তাঁর ছাত্রাবস্থায় মনের মধ্যে একটা ধর্ম জিজ্ঞাসা তৈরী হয়েছিল। ব্রাহ্মণ বাড়ির সন্তান। বাড়িতে পুজো-আচ্চা হত, কিন্তু তিনি সেসব মন থেকে যুক্তি দিয়ে সেসব মানতে পারতেন না। তাই আপনা থেকেই ভিতর ভিতর এক খোঁজ শুরু হয়। পথ আর মতকে জানার। ধর্ম-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মনীষীর জীবনী পাঠ করতেন নিয়মিত। পড়তে পড়তে এক সময় মনে হল তাঁর কথায়, ‘মনে হল আমি ব্রাহ্ম হই না কেন!’ খেয়াল ছিল না যে ব্রাহ্ম ধর্মের সময়ের থেকে তাঁর সময় অনেকটা এগিয়ে এসেছে।
তখন তিনি নতুন করে পাঠ শুরু করলেন। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে ব্রাহ্ম সমাজ লাইব্রেরিতে পড়তে যেতেন। বিনা পয়সার লাইব্রেরি। সেখানে এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তাঁকে গিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “ব্রাহ্ম হতে গেলে কী করতে হবে?”
তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, দু-তিন বছর যাক, আর একটু পড়াশোনা করো, তারপর না হয় ব্রাহ্ম হবে…”
দু-তিন বছর পর মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ব্রাহ্ম হওয়ার খেয়াল। কিন্তু হারায়নি কলকাতার হারানো সময়ের খোঁজে পথ হাঁটার ইচ্ছেটা। তাই পড়াশোনাটা চলছিল জোর কদমেই। কলকাতা তাঁর তখন থেকেই টান ।
একবার এখানের চাকরি, পড়াশোনা, জীবন, শহর ছেড়ে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেটা আশির দশক। চাইলেই থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু পারেননি। কোথায় যেন শিকড়ের গন্ধের মতো লেগে ছিল কলকাতার টান। এতদিন কবিতা হয়ে ধরা দেওয়া শব্দরা আধঘুমে জেগে উঠছিল গদ্যের শরীর পাবে বলে। সুনীল লেখেন,
“…এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝনঝনি
পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা
নতুন স্ত্ৰাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে
পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা…”
বিদেশের নিশ্চিন্তির জীবন তাঁকে শান্তি দেয়নি। একটা ছোট কবিতা লিখে তার যা আনন্দ বিদেশের বাঁধা-বাঁধনহীন উদ্দাম জীবন তাঁকে সে শান্তি দিতে পারল না। ফিরে এলেন কলকাতায়।
শহরে ফেরার পর এক কঠিন অবস্থা। চাকরি নেই। বাড়িতে দায়দায়িত্ব কম নয়। শুরু করলেন খবরের কাগজে লেখা। নানা নামে লিখতে লাগলেন। এভাবে চলতে চলতে অভাবনীয় ভাবে এলো উপন্যাস লেখার সুযোগ। সেই সময় দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ প্রস্তাব দিলেন উপন্যাস লেখার। তখনও তিনি জানতেন না কীভাবে লিখতে হয় উপন্যাস। সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন কীভাবে লিখতে হয় উপন্যাস, তার চ্যাপ্টার ভাগই বা হয় কী করে?
সে সব তো জানলেন, কিন্তু কী নিয়ে লিখবেন উপন্যাস, প্লটই বা কী হবে? ভাবতে ভাবতে লিখে ফেললেন সুনীল নামে একটা ছেলের কথা। তাকে নিয়েই এগোতে থাকল কাহিনি। উপন্যাসের নাম ‘আত্মপ্রকাশ’।
তারও বেশ অনেকগুলো দিন পর প্লট খুঁজতে খুঁজতে একদিন ফিরে গেলেন নিজের প্রিয় বিষয়ে, উনিশ শতকের গল্পে। উনিশ শতককে তুলে আনলেন সময়ের গল্পে। সেই গল্পে মিলেমিশে যেতে থাকল ইতিহাস আর পুরনো কলকাতা। যে মনীষীরা এতদিন শুধুমাত্র জীবনী গ্রন্থে আবদ্ধ ছিলেন, তাঁরা যেন রক্ত মাংসের চরিত্র হয়ে উঠল পাঠকের কাছে। থার্ড পার্সন থেকে একেবারে সরাসরি ফার্স্ট পার্সনে কথা বলে উঠলেন। লিখলেন উপন্যাস ‘সেই সময়’।
১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ অবধি বিস্তৃত ‘সেই সময়’র কাহিনি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিদারপুত্র নবীনকুমার। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধূসূদন দত্ত, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, ডেভিড হেয়ার, বেথুন সাহেব এই উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
তবে নিছক ইতিহাসের গল্পই লেখেননি তিনি, কাহিনির মধ্যে ছিল তাঁর নিজস্ব বোধ-ব্যাখ্যাও। উনিশ শতকে নবজাগরণের নতুন আলোয় চোখ রেখেছিল বাঙালি জাতি, কিন্তু সেই আলো কি সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে যেতে পেরেছিল, নাকি শুধুই ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীর নিজস্ব পরিসরে আবদ্ধ হয়ে থেকে গিয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন তিনি। ধর্ম থেকে সাহিত্য, শিক্ষা সব দিক থেকেই। রেঁনেসাসের আলোর অলিন্দ্যে সংকীর্ণতার দিকগুলোও তুলে ধরেছিলেন।
সেই সময়ের সংবাদপত্র, পত্রপত্রিকা উপন্যাসের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। উপন্যাসে বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে মিশেছিল কাল্পনিক চরিত্রও। দেবত্বের খোলস বর্জন করে অসাধারণ মনীষীরা হয়ে উঠেছিলেন দোষগুণে ভরা অকৃত্রিম মানুষ।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ তাঁকে একবার বলেছিলেন, “কী হল আমরা ইতিহাস নিয়ে এত লিখলুম-টিকলুম, লোকে বেশি পড়ে না আর তুমি যেই গল্পের ছলে বললে, আর সবাই পড়তে লাগল! ”
ইতিহাস ভুলে যাওয়া বাঙালিকে শিকড়ে ফিরিয়ে ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গল্প কথায় চিনিয়েছিলেন নিজের জাতির ইতিহাস। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত ‘সেই সময়’। আশির দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালি ফি পক্ষে অপেক্ষা করে থাকত তাঁর কলমের জন্য। রুদ্ধশ্বাসে তাঁরা সময় সফর করতেন লেখকের সঙ্গে। আত্ম বিস্মরণকে জাতি ধর্ম হিসেবে অভ্যাস করে ফেলা এক জাতির পক্ষে এ বড় কম কথা নয়।
১৯৮১ সালে দুই খণ্ডে পুস্তক আকারে উপন্যাসটি প্রকাশ করে। একই প্রকাশনী থেকে উপন্যাসের অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। ১৯৮৩ সালে পায় বঙ্কিম পুরস্কার। ১৯৮৫ সালে আকাদেমি সম্মান। সেই সময়’ ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’ মিলিয়ে সুনীল লিখে গিয়েছেন তিন পর্বে বাঙালি জাতির এক অনন্য দলিল।