‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’

কহতে হ্যায় শাওন কি ঝুলে

ভুল গয়ে তু হাম নেহী ভুলে

তেরে বিন যব আয়ি দিওয়ালী

দীপ নহি দিল জ্বলে খালি…

গান বয়ে যাচ্ছে নিঝুম অডিটোরিয়ামে। স্তব্ধ শ্রোতারা। কারুর চোখে যেন ভর করেছে বর্ষা। অঝোর ধারায় ঝরেই চলেছে অনর্গল। মনকেমনের স্মৃতি। ঘরের টান। চেনা দোর-দালান থেকে অনেক দূরে পরবাসী। ফাঁকা ফাঁকা শহরের একলা গলিতে একা একা হেঁটে চলা। সেই সব পিছুটান...

মঞ্চে যিনি গাইছেন তাঁর কিন্তু এসবের খেয়াল নেই। সাদা কুর্তা-পাজামার ওপর যত্নের আলোয়ান। হারমোনিয়ামের রিডে ছাড়া আর কোথাও মন নেই তাঁর। শুধু যখন তিনি বলেন,

পিপল শুনা পনঘট শুনা

ঘর শমশান কা বনা নমুনা ..

মনে হয় বাঁধ ভেঙে পড়বে এবার, অমন নির্মোহ মুখের অন্তরালে উপচে আসছে অনুভুতির স্রোত তাকে এড়াবে দর্শক স্রোতের সাধ্য কই! কবে কোথায় হারিয়েছে চিঠি, কবে কোন চিঠি আসেনি তার জন্য আজ প্লাবন নেমেছে। ভেসেছে ঘরবার।

এ গান থেকে পালানোর পথ নেই। সঙ্গীতকারের নাম পঙ্কজ উধাস। এক গানে কাঁদিয়েছিলেন গোটা দেশকে। গানের নাম চিটঠি আয়ি হ্যায়...মহেশ ভাটের পরিচালনায় ছবির নাম ‘নাম’।

জন্মলগ্ন থেকেই এই গানের গায়ে লেগে কান্নার দাগ। রাজ কাপুর আর রাজেন্দ্র কুমার ছিলেন খুব ভাল বন্ধু। ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গানটি লিখেছিলেন আনন্দ বকসি। সুর দিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল। এডিট করেছিলেন ডেভিড ধাওয়ান। গান তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর একদিন রাজকাপুরকে রাজেন্দ্রকুমার তাঁর বাড়িতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানালেন। বন্ধুর ডাকে আসতেই হয়! এলেন রাজ বন্ধু রাজেন্দ্রর বাড়িতে। খাওয়াদাওয়ার পর ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ শোনালেন বন্ধুকে। ন্যারেশন শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন রাজ! এ গানের নিয়তি যেন সেদিনই স্থির হয়ে গিয়েছিল…

একা রাজ কাঁদেননি। এ গানে কেঁদেছিল গোটা দেশ। হলে ‘নাম’ ছবির প্রতিটি শোয়ে প্রায় একই দৃশ্য। সেই গল্প পঙ্কজকে বলেছিলেন তাঁর মা জিতু বেন। ছবিতে এই গানের দৃশ্যে কেঁদে ফেলত দর্শকরা। আজও এই গানের আবেদন একই…

Pankaj-Udhas-Cover

পঙ্কজ উধাস। গুজরাটের জিতপুরে জন্ম। সময়টা পঞ্চাশের দশক। দেশের মাটিতে শিকলবন্দী সময়ের স্মৃতি তরতাজা। মাত্র চারবছর আগে স্বাধীন হয়েছে দেশ। দুধের শিশুর ঘুমপাড়ানি গল্পে মিশে যায় বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের কাহিনি। বাবা কেশুভাই উধাস ছিলেন কৃষিজীবী। তিন ভাইয়ের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ। তিন ভাইয়েরই সুরের নেশা প্রবল। বড় দাদা মানহর উধাস হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাকও করেছিলেন। মেজ ভাই নির্মল উধাস গজল শিল্পী। উধাস পৃবার গুজরাটের বাস ছেড়ে বোম্বাইযাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন শহর এসে পঙ্কজ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন।

পঙ্কজ বলিউডে পা রাখেন সত্তরের দশকে। তখন হিন্দি ছবির সাম্র্যাজ্যে চলছে শচীন কত্তা, নৌশাদ, মদনমোহনদের যুগ। পরিচালক ঊষা খান্নার ছবি ‘কামনা’তে প্রথম ব্রেক। হিন্দি সেই ছবি মুক্তির আলো দেখেনি। হেভিওয়েটের ভিড়ে ভীষণ কঠিন ছবি নবাগতের পায়ের তলায় জমি খুঁজে পাওয়া। চারবছর লড়লেন, কিন্তু সাফল্য অধরা। সুযোগ শক্ত।

শেষ পর্যন্ত পঙ্কজ বিদেশযাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন। জীবনের মোড় ঘুরল সেখান থেকেই। বিদেশের মঞ্চে গজল শিল্পী হিসেবে ক্রমশ নিজেকে আবিষ্কার করেন পঙ্কজ। বাড়ে জনপ্রিয়তাও। রাজেন্দ্রকুমারও তাঁর গানে মুগ্ধ। হিন্দি ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে ছিল পঙ্কজের। তবে অন্য গানে নয়, গজল শিল্পী হিসেবেই।

একদিন তাঁর কাছে ফোন এল একটা। এক প্রযোজকের অ্যাসিট্যান্টের। এই ছবিতে শুধু শোনা নয় পর্দায় দেখা যাবে পঙ্কজকে। মানে ‘ক্যামিও’। প্রযোজকের বিশেষ ইচ্ছে। সেই প্রস্তাব খুব একটা টানল না তাঁকে। ‘না’ করে দেন। কিন্তু প্রযোজক নাছোড়। পঙ্কজের দাদাকে অনুরোধ করলেন ভাইকে রাজি করানোর। পঙ্কজ উধাসের কথায়, “ যখন মানবর ভাই মাকে এসে বলেন রাজেন্দ্রজীকে কেন আমি এড়িয়ে যাচ্ছি তখন বিষয়টা মাকে বেশ অস্বস্তি ফেলল।  ছবির জন্য তখন ডেট দিতে একপ্রকার বাধ্য হলাম আমি…”

নাম ছবির গান ইতিহাস তৈরী করেছিল হিন্দি ছবির গানের জগতে। ছবিতে গজলের ব্যবহার বদলে দেয় চেনা ধারণা। গজল যে এভাবে জনপ্রিয় হতে পারে দর্শকদের কাছে তা যেন অবিশ্বাস্য!

‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ আজও একই রকম মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। পঙ্কজ উধাসের আরও বহু জনপ্রিয় গান আছে। কিন্তু তাঁর জীবনে এই গানের গল্পই আলাদা…   

  

  

 

 

 

   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...