দেবতাদের মধ্যে মহাদেবের পর সবচেয়ে বেশি পণ্ডিত হলেন গণেশ ঠাকুর। তাই মহাভারতের শ্রুতিলেখক হিসেবে ব্যাসদেব তাঁকেই নিয়োগ করেছিলেন। পুরাণে তাঁকে কবি ও পণ্ডিতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। তবুও তিনি বিদ্যার না হয়ে, ব্যবসায়ীদের কাছে সৌভাগ্যের দেবতা হয়ে উঠেছেন। এর কারণটা কী?
আঠেরোটি পুরাণে আছে গণেশের রূপের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। কোথাও তাঁর গায়ে সোনার রঙ, কোথাও বা লাল। কোথাও তাঁর হাতে অস্ত্র ও পদ্ম; কোথাও বা পুথি, কলম ও জপমালা। তাঁর নামও অনেক--'গণপতি', 'বিনায়ক', 'ঢুন্ডিরাজ' প্রভৃতি। একসময় বৌদ্ধরাও তাঁর উপাসনা করতেন। তাঁরাই একদা বিদেশের মাটিতে নিয়ে গেছেন গণেশ ঠাকুরকে। আজও প্রায় পনেরোশো বছর ধরে চীনের কুংসিনে একটি মন্দিরে তিনি ‘শো-তেন’ নামে পূজিত হন। ‘শো-তেন’ মানে, ‘হাতিদের রাজা’। জাপানে আড়াইশোরও বেশি গণেশের মন্দির আছে। সেখানে তাঁর নাম, ‘কঙ্গি তেন’। ভারতের মতো জাপানেও ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয়।
আসলে ‘হাতি’, সেই ধর্মীয়ভাবনার সূচনার কাল থেকে প্রায় সমস্ত দেশের মানুষের কাছেই সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই রাজার মুকুটে-মুদ্রায়-সিংহাসনে এককালে হস্তিচিহ্ন আঁকা হত। সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধিকে রাজা এবং রাজ্যের অনুকূলে রাখার জাদুক্রিয়া হিসেবে। গণেশের মাথা হাতির বলে, তিনি দেশের তো বটেই, বিদেশের ভক্তদের কাছেও অচিরে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দেবতা হয়ে উঠেছেন। এখান থেকেই একদা তাঁদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, গণেশের পুজো করলেই অর্থ ও সম্পদে ঘর ভরে উঠবে।
তন্ত্রের মধ্যে, মূলত ‘মহানির্বাণ তন্ত্রে’ আবার গণেশকে চোরের দেবতা বলা হচ্ছে। সেখানে তাঁর নাম, ‘চৌর-গণেশ’। সেকালে গণেশের পুজো করে চোরেরা নাকি চুরি করতে যেত। তাই তন্ত্রে চোরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে চৌর-গণেশের ধ্যান করে ‘জপজপাসু যত্তেজস্তত্র চৌরগণাধিপঃ...’ মন্ত্রটি দশ বার জপ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তখন চোরের ভয় যেমন গেরস্তের ছিল, তেমনই ছিল ব্যবসায়ীদেরও। আজও আছে।
ব্যবসায়ীমহলে গণেশের জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ, তাঁর বাহন ‘ইঁদুর’। ইঁদুর চাষির ক্ষেতের ফসল, ব্যবসায়ীর গুদাম সব নষ্ট করে দেয়। কাজেই গণেশের পুজো করলে তিনি তাঁর বাহনকে সামলে রাখবেন এবং ভক্তের ক্ষতি হতে দেবেন না, এই ভাবনা থেকেও ব্যবসায়ীভক্তদের কাছে গণেশ জনপ্রিয়।
গণেশের একটি জন্মকাহিনিতে আছে শিবের সঙ্গে লড়াইয়ের উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানে শিব কিছুদিনের জন্য কৈলাসের বাইরে থাকায় জানতে পারেননি যে, নিজেকে রক্ষা করার জন্য পার্বতী 'গণেশ' নামের একটি পুত্রের সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে প্রহরায় রেখেছেন। তাই শিব কৈলাসে ফিরে সরাসরি পার্বতীর কাছে যেতে গিয়ে অচেনা একটি একগুঁয়ে বালকের কাছে যখন বাধা পেলেন, তখন স্বভাবতই শিব রেগে গেলেন। দুজনের মধ্যে শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন গণেশ। পরে, পার্বতীর অনুরোধে শিব গণেশকে বাঁচিয়ে দিলেন, পুত্র বলে স্বীকার করলেন এবং সমস্ত দেবতার পূজার আগে, যজ্ঞ বা উপাসনার আগে গণেশের পূজা না-করলে ভক্তের পূজা সফল হবে না বলে বর ও বিধান দিয়ে বসলেন। এখান থেকেই গণেশ হয়ে গেলেন ‘সিদ্ধিদাতা’ ও আরম্ভের উপাস্য দেবতা। এই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে ব্যবসার সমৃদ্ধি কামনায় ব্যবসায়ীরা নববর্ষ বা হালখাতায় তো বটেই, এমনকি ব্যবসা আরম্ভের আগেও প্রতিদিন গণেশ পুজো করতে শুরু করেন।