দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। পৃথিবীটা যেন রাতারাতি ছোট হয়ে গিয়েছে। মানুষের ভিড় থেকে এক্কেবারে একা। রাজপথ থেকে রাতারাতি বাড়ির জানলায়। কাচ কিংবা গরাদের অন্তরালে। শরীরী বিচ্ছন্নতা এলেও অন্য পৃথিবীর দরজাটা খোলাই আছে। আর কোয়ারেন্টাইন এর দিনগুলোতে সেই ভার্চুয়াল দুনিয়াকেই আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে মানুষ। করোনায় গৃহবন্দী জীবন মানুষকে পুরনো স্মৃতির কাছে ফিরিয়ে এনেছে। ফিরে এসেছে পুরনো অভ্যাস। কিছুটা যেন তার ছোঁয়াতেই বদলে যাচ্ছে প্রতিদিনের চেনা অভ্যাস। বছরের পর বছর ধরে ইঁদুর গতির জীবনে যা হারিয়ে গিয়েছিল সেই সব অভ্যাসের কাছেই ফিরে আসতে হচ্ছে তাকে। সেভাবেই যেন মানুষ নতুন করে ফিরে এসেছে বইয়ের কাছে।
করোনা পরিস্থিতিতে আশ্চর্য জনক ভাবে বইয়ের চাহিদা। বিশ্ব জুড়েই।
তার মধ্যে হার্ডকপি মানে ছুঁয়ে দেখা বই যেমন আছে তেমনই একেবারে এক আলাদা রকম চাহিদা তৈরি হয়েছে অনলাইনে পড়ার বই এর। অর্থাৎ ই-বুক এর।
গত দুই সপ্তাহে এই চাহিদা একেবারে ৩২-৩৫ শতাংশে উঠে এসেছে।
হোম- আইসোলেশনে থাকার সময় সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠেছে বই। অনেক হারিয়ে যাওয়া বই ফিরে আসছে। যা হয়ত বহুদিন আগে প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই পুরনো কপিই পিডিএফ চেহারায় পৌঁছে যাচ্ছে মানুষদের কাছে। গড়ে উঠছে ব্যক্তিগত ই-বুক লাইব্রেরী। অনেকে সেই দুর্লভ বই এর সংগ্রহ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছেন সহ নাগরিকদের জন্য। শুধু ইংরেজি না, সব ভাষাতেই চলছে এই 'ট্রেন্ড'।
লাইব্রেরী একেবারে অন্যভাবে ফিরে এসেছে। আগে মানুষ যেত লাইব্রেরীতে। এখন লাইব্রেরী আসছে মানুষের কাছে। স্বভাব-পড়ুয়া মানুষ, ছাত্রছাত্রী ছাড়াই বহু মানুষ সদস্য হচ্ছেন এই সব লাইব্রেরীতে। বিশ্বের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় করোনার সময়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য তাদের অনলাইন লাইব্রেরীর দরজা খুলে দিয়েছে। বাড়ছে অডিয়ো বুকের কদরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক ডাউনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে 'লোকাল লাইব্রেরী' যাওয়ার সুযোগ। ওই সমস্ত লাইব্রেরীগুলো তাই নিজেদের ওয়েবসাইটে বই পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। সদ্য প্রকাশ হওয়া যে বই হাতে পাওয়ার জন্য মানুষকে বুকস্টোরে লম্বা লাইন দিতে হত বা লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগের জন্য মাস খানেক অপেক্ষা করতে হত এখন মাউস ক্লিকেই চোখের সামনে হাজির সেই বই!
অনেক লাইব্রেরী আবার কবে লকডাউন উঠবে সেই অপেক্ষায় না থেকে অনলাইনে মেম্বারশিপ দেওয়া চালু করেছে। পিছিয়ে নেই পাবলিশিং হাউসগুলো। তারা করোনার সময় মানুষকে ' মেন্টাল রিলিফ' দিতে ব্যবস্থা করেছে ফ্রি সাবস্ক্রিপশন এর। লেখক লেখিকারাও এমন উদ্যোগ নিচ্ছেন ব্যক্তিগতভাবে। যেমন নিয়েছেন ব্রাজিলের বিখ্যাত লেখক পাওলো কোয়েলহো। করোনার দিনগুলোতে তাঁর উপন্যাসের ই-ভার্সন ফ্রি করে দিয়েছেন। তাঁর পেজে গেলেই মিলবে পড়ার সুযোগ। ইংরেজি, পর্তুগিজ তো আছেই সমস্ত অনূদিত ভাষাতেই পড়া যাবে। শুধু কি বই! পত্র-পত্রিকা, জার্নালও এভাবে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে পাঠকরা। নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে অনলাইনে। থেমে নেই বই পৃথিবী।
বিশেষজ্ঞদের মতো একাধিক দেশে একই সঙ্গে লক ডাউন রাতারাতি বদলে দিয়েছে ই- অর্থনীতির চেহারা। সেই বদল চিরস্থায়ী হতে চলেছে। করোনার প্রকোপ শেষ হয়ে গেলেও করোনা কালীন কিছু অভ্যাস থেকেই যাবে মানুষের মধ্যে। সেরকমই এক অভ্যাস 'বই'। বইয়ের জগতের হালচাল প্রতিদিন বদলে দিচ্ছে করোনা। উঠে আসছে নতুন নতুন বিকল্প। আর সেই বদলকে স্বাগত জানাচ্ছে মানুষ। এমন দিন দেরী নয়, যেদিন ড্রোনে করে বই পৌঁছে যাবে মানুষের বাসার দরজায়। বইয়ের ক্রেতা- বিক্রেতা দুই পক্ষই আশাবাদী।কী ভাবছে আমাদের কলেজ স্ট্রিট!