নানা ভাষা নানা মতের মতোই , নানা 'অব্দ' বা 'সন'-এর ছড়াছড়ি এই ভারতবর্ষে। বঙ্গদেশ ও তার প্রতিবেশী প্রদেশগুলোও কম যায় না। গুপ্ত রাজা বিক্রমাদিত্যের 'বিক্রমাব্দ', কুশান রাজা কণিষ্কের 'শকাব্দ', রাজা লক্ষণ সেনের 'লক্ষণাব্দ', ত্রিপুরার রাজাদের 'ত্রিপুরাব্দ', বর্মী রাজা পোপা স্বরাহণের 'মগী সন' প্রভৃতির সঙ্গে 'হিজরী', 'মল্লাব্দ', 'বঙ্গাব্দ'-তো রয়েইছে। এখন প্রশ্ন হল, 'বঙ্গাব্দ' বাংলায় চালু হল কীভাবে?
বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসেবে কেউ বলেন সম্রাট আকবরের কথা, কেউ বলেন মগ রাজা বল্লালের কথা। 'আইন ই আকবরী' বা 'আকবর নামা'-তে আকবরের 'ইলাহি অব্দ' নামে এক নতুন অব্দ চালু করার কথা আছে, কিন্তু কোথাও বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। গবেষক গোলাম মুরশিদ তাই স্পষ্টই জানিয়েছেন যে, বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কোনভাবেই আকবর নন। 'বঙ্গাব্দ'-গ্রন্থে গবেষক জয়নাল আবেদীন খান প্রমাণ করেছেন, আকবর নন, আরাকানের রাজা বল্লালই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। ইনি সেন-বংশের রাজা বল্লাল সেন নন, ধর্মান্তরিত এক মুসলিম রাজা। 'মগী সন'-এ তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের সুষ্ঠু বিন্যাস এবং চৈতি-ফসল তোলার পর খাজনা আদায়ের সুবিধের কথা মাথায় রেখেই প্রথম 'বঙ্গাব্দ' চালু করেছিলেন। ব্যাপারটা যখন ঘটল, তখন তিনি ভাগ্যবিপর্যয়ে সম্রাট শাহজাহানের একজন করদ-সামন্ত মাত্র। তাঁর নিবাস তখন, ঢাকা শহরের তিন মাইল উত্তরে, এক বনাঞ্চলে। বল্লালের আরও তিনটি নাম ছিল--নবাব আবুল কাশেম, মঙ্গত রায় ও শ্রীধরমশা। তাঁর ধর্মান্তরে পাওয়া 'আবুল' নামটিই লোকমুখে হয়ে উঠেছিল, 'বল্লাল'। ইনি আরাকানের রাজা মলহন, নামান্তরে হুসেন শাহের কনিষ্ঠ পুত্র। বল্লাল মুসলিম হলেও হিন্দুধর্মের আচার ছাড়তে পারেননি। মূর্তি পূজা করতেন, শক্তি সাধনা করতেন এবং তান্ত্রিকক্রিয়ার চর্চাও করতেন। সতেরো শতক এঁর সময়কাল। এখন প্রশ্ন হল, ইনি প্রবর্তকের ভূমিকা নিতে গিয়ে বঙ্গাব্দের ধারণাটি পেলেন কোথায়?
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা হলেন পোপা স্বরাহণ। সিংহাসন আরোহনের সময়টিকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি 'মগী সন' প্রবর্তন করলেন। মগী সন হল সৌর ক্যালেন্ডার-অনুসারী। এতে মেষ রাশিতে বছর শুরু, মীন রাশিতে শেষ। বৈশাখ মেষ রাশির মাস। তাই বছর শুরুর মাস। বৈশাখের বর্মী নাম, 'কাছঙ'। এই অঞ্চলের প্রাচীন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা কিন্তু তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে বছর-মাসের হিসেব রাখতে 'মগী সন'টি নিলেও, মাসের নামটি নিলেন নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তাঁরা এতদিন অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরতেন। এবার থেকে হিসেবটি পুরো পাল্টে গেল।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখকে বেছে নেওয়ার মূলে রাশিঘটিত ব্যাপারটি ছাড়াও আর একটি কারণ আছে। বৈশাখী পূর্ণিমাতিথিতে এ-ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জীবনে তিনটি বিশিষ্ট ঘটনা ঘটেছিল। জন্ম, বোধিজ্ঞান লাভ এবং মৃত্যু। বৈশাখ মাস তাদের কাছে তাই, পুণ্যমাস। মাসের প্রথম দিনটিও তাঁদের কাছে বড় পবিত্র। জল ছিটিয়ে আনন্দ করে, পথে খৈ ছড়িয়ে, নতুন কাপড় পরে, অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় জল ঢেলে, একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানিয়ে, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে, আমন্ত্রণ করে খাইয়ে এদিন তাঁরা পবিত্র মাসটিকে বরণ করার উৎসবে মেতে উঠতেন। কালক্রমে এটাই হয়ে উঠল, 'নববর্ষের উৎসব'।
'নববর্ষ' এলো, তার গা ঘেঁষে 'হালখাতা'ও এলো। 'হাল' আরবি শব্দ, যার অর্থ, 'বর্তমান বা চলতি'। 'খাতা' ফারসি শব্দ, যার অর্থ, 'হিসেবের কড়চা'। দুয়ে মিলে, 'চলতি বছরের হিসেবের কড়চা'। নতুন বছরের হিসেব রাখার জন্য খাতা বদলের ইতিহাস মোঙ্গল-চিনে পাওয়া যায়। সেখান থেকে এই রীতি এলো মুসলিম শাসকদের হাত ধরে। জমিদারেরা হিন্দুরীতিতে খাতা-বদলের এই অনুষ্ঠানটির নাম দিয়েছিলেন, 'পুন্যাহ'। এদিন স্নানশুদ্ধ জমিদারেরা তাঁদের কর্মচারীদের সঙ্গে সেরেস্তায় বসতেন। প্রজারা আসতেন বিগত বছরের বকেয়া খাজনা মিটিয়ে দিতে। এই উপলক্ষ্যে সেরেস্তায় তাঁদের জন্য অন্ন কিংবা মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা থাকত। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হলে রীতি-ঐতিহ্যের এই ধারাটি পুরো অধিগ্রহণ করে নিল বেনে-ব্যবসায়ীরা। সেকালে জমিদার মুসলিম হলে এই হালখাতার শুভারম্ভ করতেন, খাতার মাথায়, 'বিসমিল্লাহ' লিখে। হিন্দু হলে, 'শ্রী শ্রী গণেশায় নম:'।
আবার একটা প্রশ্ন। হালখাতায় গণেশ জুটলেন কি করে? বৌদ্ধ ও হিন্দু প্রভাব--দুইই কাজ করেছে এর মূলে। শ্বেতহস্তী বৌদ্ধদের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক। 'জাতক'-গ্রন্থ থেকে জানা যায় বুদ্ধদেব একবার শ্বেতহস্তীরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হিন্দুর পুরাণ-দেবতা গণেশের মাথাটিও শ্বেতহস্তীর। তিনি সিদ্ধিদাতা। ফলে, এই দুই প্রভাবে কোথাও মিলে মিশে গিয়ে হালখাতায় পাকাপাকি ঠাঁই পেয়ে গেলেন গণেশ।
সুতরাং, আজ সমগ্র বাংলায় এই যে নববর্ষের ঐতিহ্য, এ-কারও একার অবদান নয়, হিন্দু-বৌদ্ধ ও ইসলাম--তিন ধর্মসম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত মিলমিশের ফসল।
তথ্যঋণ: বঙ্গাব্দ - জয়নাল আবেদীন খান