দেবতাদের পাশাপাশি দেবীরা পূজিতা হন বঙ্গে। শক্তির আধার হলেন দেবীরা। বাংলার দেবী হলেন চণ্ডী, বাংলায় মেয়ে-বউরা সংসারকে বিপদ মুক্ত রাখতে বিপত্তারিণী চণ্ডীর পুজো করেন। আদপে দেবীর ব্রত পালন করা হয়। রথ ও উল্টোরথের মাঝে শনি ও মঙ্গলবার মা বিপত্তারিণীর পুজো হয়। তন্ত্রে দেবীর উল্লেখ রয়েছে। 'বিপত্তারিণী কথামৃতম' বা 'তারিণ্যুপনিষদ' গ্রন্থে জনার্দন লিখেছেন, তাঁর মা হরিপ্রিয়া দেবীর কৃপা লাভ করেছিলেন। 'বিপত্তারিণীতন্ত্রম' নামে আরও একটি পুঁথির খোঁজ পাওয়া যায়। দেবী বিপত্তারিণীর রূপের সঙ্গে দেবী সংকটতারিণীর সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি শঙ্খ, চক্র, শূল ও অসিহস্তা স্বর্ণবর্ণা ত্রিনয়না, আবার তিনি খড়গ, শূল, বরাভয়দায়িণী ঘোরকৃষ্ণা। কলকাতা ও শহরতলিজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দেবীর মন্দির।
মল্লভূমের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে বিপত্তারিণীর পুজোর কথা। মল্ল রাজবংশেরই এক রাজার পত্নী ছিলেন ধর্মপরায়ণ৷ এক মুচি পত্নীর সঙ্গে তাঁর ভীষণ সখ্যতা ছিল। মুচিরা গোমাংস খেতেন৷ একদিন রানির কৌতূহল জন্মাল, গোমাংস কেমন তা তিনি নিজে খেয়ে দেখবেন। রানী একথা জানাতেই মুচি স্ত্রী ভয়ে কাঁটা। কিন্তু মহারাজ যদি জানতে পারেন, তবে মুচির মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। কিন্তু মুচি পত্নী রাজি হল। একদিন গোমাংস রেঁধে সে রানিমাকে দিয়ে গেল। কোন এক রাজকর্মচারীর মুখে একথা শুনে ক্রোধে রাজা অন্দরমহলে এলেন। কীভাবে গো মাংস লুকাবেন ভেবে পাচ্ছেন না রানি। আঁচলের তলায় মাংসের পাত্র লুকিয়ে ফেলে মা দুর্গাকে ডাকতে লাগলেন তিনি। আঁচলের নীচ থেকে বেরিয়ে এল একথালা রক্তজবা ফুল৷ এরপর থেকেই মা বিপত্তারিণীর আরাধনার প্রচলন হল। বিপত্তারিণী বিপদ থেকে রক্ষা করেন। মায়ের পুজো আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া থেকে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গলবার এবং শনিবার হয়ে থাকে। লক্ষণীয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া অর্থাৎ রথযাত্রা এবং শুক্লা দশমী অর্থাৎ উল্টোরথের মধ্যে এই পুজো হয়। বিপত্তারিণীর আসলে দেবী দুর্গারই এক রূপ। মূলত মহিলারা ওই দিন উপবাসে থেকে দেবীর পুজো অর্চনা করেন। মনষ্কামনা করে হাতে লাল সুতো পরেন। অনেকে আবার মনষ্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডিও কাটেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় নদী বা কোন জলাশয়ে স্নান সেরে দণ্ডি কেটে পুজোর জায়গায় গিয়ে পুজো দেন। অনেকেই মনে করেন মা বিপত্তারিণী আসলে বাংলার এক লৌকিক দেবী। তবে মার্কণ্ডেয় মুনি প্রথম বিপত্তারিণী ব্রত কথা প্রচার করেন।
প্রভু জগন্নাথ উল্টো রথের দিন বাড়ি ফেরেন। জগন্নাথদেবের রথ থেকে উলটো রথযাত্রার মধ্যে বিপত্তারিণী দেবী চণ্ডীর আরাধনায় সকলে ব্রতী হন। ভগবান কৃষ্ণই প্রভু জগন্নাথ, আর সকল দৈবীরূপী শক্তিময়ী দেবী চণ্ডীর হাতে অসুর, দৈত্য, দানবের বিনাশ হয়। নারদীয় পুরাণে তাই বিষ্ণুকে সর্বশক্তিমান এবং দুর্গাকে সর্বশক্তিময়ী বলা হয়েছে। বৈদিক যুগে এই রথের সময়েই ভগবান বিষ্ণু ও গৌরীর পুজো প্রচলিত ছিল। ঐতিহ্য মেনে রথের পরেই বিপত্তারিণী চণ্ডীর পুজো চলে আসছে। মহাভারতে যুদ্ধের পূর্বে পাণ্ডবদের বিপদ নাশ ও নিজের বৈধব্য প্রতিরোধের জন্য দ্রৌপদী গৌরীর আরাধনা করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে স্বামীর জীবন রক্ষায় তাঁদের হাতে ১৩টি লাল সুতো বেঁধে দিয়েছিলেন। আজও বিপত্তারিণী পুজো শেষে রক্ত সূত্রের ত্রয়োদশ গ্রন্থিযুক্ত ডোর ধারণ করা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বিপত্তারিণী পুজোর বিধান রয়েছে। পুজোয় ১৩টি ফল, ১৩টি ফুল, ১৩টি মিষ্টি, ১৩টি পান সুপারি ও ১৩টি নৈবেদ্য দানের কথা বলা হয়েছে। সারা বছর বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পেতে ১৩টি উপাচারে নৈবেদ্য সাজিয়ে মায়ের আরাধনায় সকলে ব্রতী হন।
কলকাতায় তিন চণ্ডীমন্দির রয়েছে। বড়িশার চণ্ডীবাড়ির খুবই বিখ্যাত। বেহালার সখের বাজার মোড়ের কাছেই রয়েছে বড়িশার চণ্ডীমন্দির। জনশ্রুতি অনুযায়ী, চণ্ডীমন্দির প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন। সাবর্ণ পরিবারের মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী ১৭৯২ সালে দুর্গাপঞ্চমীর দিন নিজের বাড়িতে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাবর্ণদের এই বাড়িই চণ্ডীবাড়ি নামে পরিচিত। চণ্ডীবাড়িটি তিনতলা মন্দির। মন্দিরে চণ্ডীর অষ্টধাতুর কলস রয়েছে, যা নিত্য পূজিত হয়। চণ্ডীবাড়ির কাছেই চণ্ডীমন্দির, সেখানেই বছরে একবার মৃন্ময়ী রূপে আসেন দেবী, পূজিত হন। মহেশচন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র হরিশচন্দ্র রায় চৌধুরী মন্দিরটি গড়েছিলেন। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী এবং নবমীতিথিতে চণ্ডীপুজোকে মহোৎসব হয়, মেলা বসে। অগ্রহায়ণ মাসে মায়ের বার্ষিক পুজো হয়। বিপত্তারিণী চণ্ডীপুজোর দিন ভক্ত সমাগম হয়। দেবীকে লুচিভোগ দেওয়া হয়। লুচি ছাড়াও বিভিন্ন রকমের ভাজা, তরকারি, মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয়। লেকগার্ডেন লস্করপুরে রয়েছে কালীবাজার বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়ি। রাজপুরের চণ্ডীবাড়ি থেকে পুরোহিত এসে এখানে মাকে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। রাজপুর বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়িরই রীতি মেনে মায়ের পুজো করা হয়। কালীবাজারের চণ্ডীবাড়িতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মহাসমারোহে পুজো হয়। কালীপুজোর দিন অন্নকূট হয়।
রাজপুরে বিরাজ করছেন মা বিপত্তারিণী। গড়িয়া থেকে বারুইপুর যাওয়ার পথে, রাজপুর বাজারের আগে বাঁদিকে কিছুটা এগোলে পড়বে বিপত্তারিণী চণ্ডী মন্দির। জনৈক বাবা দুলাল মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাবা দুলাল হলেন সাধনচন্দ্র দাস ও বসন্তকুমারী দাসের পুত্র দুলালচন্দ্র দাস। ছোট থেকেই দুলাল ছিলেন ঈশ্বর ভক্ত। পরবর্তীতে তিনি ঈশ্বর সাধনা আরম্ভ করেন। দেবী চণ্ডীকে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুলাল।
শোনা যায়, বেলগাছের নীচে বসে কৃষ্ণবর্ণা সিংহবাহিনী দেবীর সাধনা করেন দুলাল। দুলালের সাধনার জায়গা রত্নবেদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভক্তদের দাবি, দুলালের কাছে গিয়ে কোনও মনস্কামনার কথা জানালে, তিনি তা পূরণ করে দিতেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মন্দিরের মা ভক্তদের মনস্কামনা পূরণ করেন। মন্দিরে আজও নিত্যপুজো হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, দুলালচন্দ্র দাস দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। দেবীই তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, তাঁর রূপ কেমন হবে। কীভাবে তাঁর পুজো করতে হবে। দেবী চণ্ডীরকে ঘিরে রয়েছে অজস্র অলৌকিক কাহিনি। এখানে বিপত্তারিণী দেবী চারহাত বিশিষ্টা। একহাতে রয়েছে খড়্গ, আরেক হাতে রয়েছে ত্রিশূল। অন্য দুই হাতে দেবী বরাভয় এবং অভয় দানকারিণী। বাবা দুলাল প্রথম ইচ্ছায় দক্ষিণাকালীর মূর্তি তৈরি করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন দক্ষিণাকালী নয়, বিপত্তারিণী চণ্ডীর মূর্তি গড়তে। দেবী তাঁর রূপও বলে দেন, অর্থাৎ এখানে দেবী সিংহবাহিনী, তাঁর চার হাত, এক হাতে মহাশূল, এক হাতে খড়গ ও অন্য দুই হাতে বরাভয় ও অভয় দান করছেন তিনি। তিনি আরও জানিয়ে দেন, সকল ভক্তকে বিপদে উদ্ধার করতেই তিনি বাবা দুলালকে দিয়ে তাঁর প্রচার করাতে চান। শুধুমাত্র মূর্তিরই বর্ণনা নয়, তিনি পুজোর পদ্ধতিও শিখিয়ে গিয়েছিলেন দুলাল বাবাকে। সেই থেকে রাজপুরে মা বিপত্তারিণী চণ্ডী পূজিত হচ্ছেন।
প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মন্দিরে ভক্ত সমাগম বাড়ে। এছাড়াও বছরে দুবার বিশেষ পুজো হয়। সোজা ও উলটোরথের মাঝের মঙ্গলবারে হয় বিপত্তারিণীর পুজো। সেদিন ভোর থেকে ভক্ত সমাগম শুরু হয়ে যায়। দেবীকে ১৩ রকমের ফল ও মিষ্টি দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। ছাড়াও দুর্গাপুজোর নবমী তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। রাজপুর চণ্ডীবাড়িতে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয় দুর্গাপুজোর নবমীর দিন। দেবীর দুর্গার উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করার নেপথ্যেে একটি ঘটনা রয়েছে। ওই অঞ্চলে প্রাচীন এক দুর্গাপুজো হয়। একদিন বাবা দুলাল স্বপ্নাদেশ পান, নবমীর দিন যেন তাঁর জন্য ভোগ দেওয়া হয়। সেই থেকে দুর্গাপুজোর মহানবমীর দিন দেবী দুর্গার উদ্দেশে ভোগ দেওয়া হয় চণ্ডীবাড়ি থেকেই। রাজপুর বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়িতে এক সংগ্রহশালা রয়েছে, যেখানে বহু পুরোনো জিনিস রয়েছে যা বাবা দুলাল ব্যবহার করতেন, রয়েছে রাজপুরের চণ্ডীবাড়ির প্রাচীন কিছু ছবিও। মা চণ্ডীর বিগ্রহ ছাড়াও এখানে বহু দেবদেবীর বিগ্রহ রয়েছে, তার সঙ্গে বাবা দুলালের বিগ্রহও রয়েছে।