ভাষাকে জ্যান্ত রাখতে আর কত নমনীয় হবে বাঙালি?

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই একটি দিনে বাঙালি আরও বেশি করে বাঙালি হয়ে ওঠে! পাঞ্জাবি-শাড়ি আর কলা পাতায় বাঙালি থুড়ি 'বেঙ্গল' থালিই কি কেবল বাঙালিয়ানার পরিচয়? একুশ শতকের তৃতীয় দশক ভাষাগত জাতীয়তাবাদের দশক, ক্রমে আরও বাড়বে এ জিনিস। অগ্রজেরা মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করে গিয়েছেন। কিন্তু সে'দুগ্ধে কি জল মিশছে? আস্তে আস্তে কমছে সে'দুধের গাঢ়ত্ব?

বাংলা ভাষায় বহু ভাষার শব্দ এসেছে, মিশেছে হয়ে উঠেছে আমাদের ভাষার উপাদান। উর্দু, পর্তুগিজ, ফার্সি কোন ভাষা নেই! ভাষাকে জ্যান্ত রাখতে গেলে, এ অনুপ্রবেশকে স্বাগত জানানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আজ যে বাংলা ভাষা বলা হচ্ছে, তাতে কি ভাষা জ্যান্ত থাকবে? সজীব রাখার তাগিদে আরও বেশি করে বিপন্ন হয়ে পড়ছে না তো বাংলা।

সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে, তিনি কুর্তা-পাজামা পরেছিলেন। কুর্তা? পাঞ্জাবি-পায়জামার মতো শব্দ থাকে কেন প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিকের সম্পাদককে কুর্তার সাহায্য নিতে হল! নিত্যদিনের কথাবার্তায় আম বাঙালিও 'হিংলা' (পড়ুন হিন্দি, ইংলিশ ও বাংলা) ভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। সঙ্গে থাকে পদ্যের সাথে-কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বাঙালি।

IMG-20240220-WA0032

আদ্যন্ত বাঙালি, ক্যাব চালক তাঁকে ফোন করতেই বলে উঠছেন, ‘হা ভাইয়া আপ কাহা পড় হো?’, সুইগির ছেলেটিকে বলছেন, ‘মন্দির কি পিছেওয়ালে গলি সে আ জাও’, বাসে উঠেই বলছেন ‘দো বিশ দো’; এই করে করেই তো বাঙালি জেনে শুনে বিষ পান করে ফেলল। ভেবে দেখেছেন, ক্যাব চালকের নাম হয়ত সমর মুখোপাধ্যায়, সুইগির হয়ে খাবার দিতে আসা ছেলেটা হয়ত আপনার চেয়েও স্পষ্ট বাংলা বলে, কন্ডাক্টর হয়ত টিকিট দিতে দিতে বলবেন ‘এ নিন দাদা।’ এভাবেই তো হারিয়ে যাচ্ছে আস্ত একখানা বাংলা ভাষা। ইংরেজি ভাষার কয়েকটি বেসরকারি স্কুলে বঙ্গ সন্তান বাংলায় কথা বললে জরিমানাও দিতে হয়। বাংলায় বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। হিন্দি ছবি প্রেক্ষাগৃহে অগ্রাধিকার পায়। ফেসবুক পোস্ট করি, বাঙালি বঞ্চিত বলে কাঁদুনি গাই। সত্যজিতের অস্কার, রবি ঠাকুরের নোবেল আর সৌরভের জামা ওড়ানোর গল্প বলে ঘুমিয়ে পড়ি।

এক সময় বলা হত, ইংরেজি সংবাদপত্র নিয়মিত পড়তেন। বড়রাই নিদান দিতেন, কেন? তাতে ইংরেজি ভাষার দখল বাড়বে। সিনেমা, সাহিত্য আর সংবাদপত্র ভাষার রূপ, গঠন রচনা করে। ব্যবহারকারীরা তা থেকেই সমৃদ্ধ হয়। আজকাল আর সিনেমা দেখা, বা সাহিত্য পড়ার সময় নেই মানুষের। সে ত্রিশ সেকেন্ডের রিল দেখে, ভ্লগ দেখে, অন্যের নাওয়া, খাওয়া, ঘুমানো, বেড়ানো দেখে। সেই ভাষা ঢুকে পড়ছে বাংলায়, কড়াইতে মাখন দেওয়া দেখে হিন্দিভাষী ভ্লগার বলেন 'ও ভাই সাব', বাঙালি ফুড ভ্লগার আবেগ প্রকাশ করতে সেই ভাষাই ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছেন। ধীরে ধীরে ও ভাই সাব বাংলা হয়ে গেলেও যেতে পারে! লোকজন বলছে, দাবিয়ে খেয়েছি, ওষুধ নিয়েছি, এক কেন কী-কে তাড়া করতে গিয়ে কী কী সব জাঁকিয়ে বসছে! ধরতে পারবেন না! সামনে বদলে আগে ব্যবহার হতে শুরু হয়েছে। আবেগ প্রকাশ হচ্ছে হিন্দিতে, মোহনবাগানের জয় দেখে বাঙালির ঘরের ছেলে বলে উঠছে, 'ইসকা নাম হ্যায় মোহনবাগান!' তাতে লোকের গর্ব হচ্ছে। আর যে লোকটা রাঢ় বাংলায় বসে বা উত্তরের কোনও গ্রামে বসে বাংলা ভাষার কোনও একটি উপভাষায় কথা বলছে, তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হচ্ছে। কী করুন অবস্থা!

বাঙালি না হলে, বুঝতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্যে আজও রাত জাগতে পারে কয়েক কোটি লোক, ইলিশ হলে যে চাল একটু বেশি নিতে হয়। ছাতিমের গন্ধ, বোরোলিন, জয়নগরের মোয়া, নলেন গুড় মেশা বাংলার সংস্কৃতি বেহাত হয়ে যাবে না তো? ভাষাগত জাতীয়তাবাদ তথা বোধ পারে একমাত্র ভাষাকে সজীব রাখতে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...