গণেশ বন্দনা ছাড়া শুভ কাজ করে না বাঙালি

আজ গণেশ চতুর্থী, বাংলার দিকে দিকে পার্বতী-পুত্রের পুজো হচ্ছে। কেউ কেউ একে বহির্বঙ্গীয় সংস্কৃতি বলে দেগে দেন। এ'কথা ঠিক অধুনা এই তিথিতে তাঁর পুজোর বহর বেড়েছে। কিন্তু ভাদ্রের শুক্ল চতুর্থীতে যে একেবারে গণেশের পুজো হত তা নয়। 

বাঙালির বছর শুরু হয় গণেশ আরাধনার মধ্যে দিয়ে, বৈশাখে। যেকোনও শুভ কাজ, ব্যবসা থেকে গৃহ; যেকোনও শুভারম্ভে গণেশ পুজো পান। যেকোনও পুজোর শুরুতে তাঁর বন্দনা হয়। ভাদ্র ও মাঘ, বছরের দুটি শুক্ল চতুর্থীতে গণেশ পূজিত হন। 

বাঙালি গণেশকে দাদা হিসাবে দেখে, তাই তো বঙ্গ সন্তানেরা বলতে পারেন...

"গনেশ দাদা পেটটি নাদা

গায়ে মেখেছো সিঁদুর।

কলাগাছকে বিয়ে করেছ

বাহন তোমার ইঁদুর!"

বাঙালির গণেশ নধরকান্তি, ভুঁড়িওয়ালা সুখী শরীর তাঁর। তাঁর গাত্র বর্ণ লাল। তিনি উপবীত ধারী। অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলা-য় রয়েছে, "পেটটি বিলিতি-বেগুনের মতো রাঙা চিকিচিকে, মাথাটি শাদা, শুঁড়টি ছোট-একটা কেঁচোর মতো পেটের উপর গুটিয়ে রয়েছে; কানদুটি যেন ছোট দুখানি কুলো, তাতে সোনার মাকড়ি দুলছে; গলায় একগাছি রূপোর তারের পৈতে ঝোলানো; পরনে লাল-পেড়ে পাঁচ-আঙুল একটি হলদে ধুতি, গলায় তার চেয়ে ছোট একখানি কোঁচানো চাদর; মোটা-সোটা এতটুকু দুটি পায়ে আংটির মতো ছোট-ছোট ঘুঙুর, গোল-গাল চারটি হাতে বালা, বাজু, তাড়; গলা থেকে লাল সুতোয় বাঁধা ছিটমোড়া ছোট্টো ঢোলকটি ঝুলছে।"

বাংলায় এমন কোনও পুজো হয় না যেখানে গণেশের আরাধনা হয় না। মন্ত্রোচ্চারণের শুরুতে গণেশ বন্দনা করে নেন পুরোহিতেরা। সিদ্ধি-সমৃদ্ধির দেবতাকে বছরে দু'বার পুজো করে বাংলা। পুণ্যাহের সময় অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে এবং কেউ কেউ অক্ষয় তৃতীয়ায় লক্ষ্মীর সঙ্গেই পূজিত হন তিনি। দীপান্বিতা কালী পুজোর দিন লক্ষ্মী পুজো করেন অনেকেই, কিছু কিছু বাড়িতে ওইদিন লক্ষ্মীর সঙ্গে গণেশও পুজো পান। ছাড়াও দেবী দুগ্গার সঙ্গে তিনি আসেন। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, দুর্গার সব সন্তানরা যখন পরিবারের সঙ্গে ছাড়াও একবার করে আলাদা আসেন তখন গণেশ কেন একা আসেন না?

এ'কথা ঠিক গণেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে কখনও লক্ষ্মীর সঙ্গে কখনও সপরিবারে পূজিত হন কিন্তু তিনি একাও আসেন। হ্যাঁ, বাংলাতেই আসেন। বহু বনেদি বাড়িতে মাঘ মাসে পূজিত হন গণেশ, আর এককভাবেই হন। ভবানীপুরের মল্লিক বাড়িতে মাঘ মাসের শুক্ল চতুর্থীতে অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীর আগের দিন গণেশ পুজো হয়। ভাদ্রর শুক্ল চতুর্থী ছাড়াও মাঘের শুক্ল চতুর্থীকেও তার আবির্ভাব দিবস মনে করা হয়। বাঁকুড়ার খিলকানালি গ্রামের সরস্বতী মন্দিরে মাঘের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজোর সময় লক্ষী, সরস্বতী এবং গনেশের এক সঙ্গে পুজো হয়। 

বাংলায় আবার গণেশ শিশু রূপেও পূজিত হন বঙ্গে, গণেশ জননী-র সঙ্গে। অবন ঠাকুর থেকে যামিনী রায়, সকলের ক্যানভাসেই ধরা দিয়েছে দেবীর গণেশ জননী রূপ। মায়ের কোল আলো করে বসে আছেন ছোট্ট গণেশ। মাঘী পূর্ণিমার পর শান্তিপুরে গণেশ জননীর আরাধনা হয়, স্বামী মহেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে গণেশ জননী শান্তিপুরে আসেন। গণেশ জননী পুজোর সূত্রপাত শান্তিপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পরিচালিত অন্নপূর্ণা পুজোকে কেন্দ্র করে। সাহা পরিবারের সদস্যরা অন্নপূর্ণা পুজোর দায়িত্বভার সুবর্ণ বণিক এবং কংস বণিকদের হাতে তুলে দেন। তাঁরা পুজো করতে থাকেন। শোনা যায়, দেড়শো বছর আগে অন্নপূর্ণা পুজো উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এক যাত্রা পালাকে কেন্দ্র করে সুবর্ণ বণিক ও কংস বণিকের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। তখন কংস বণিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা গণেশ জননীর পুজোর প্রচলন করেন। কথিত রয়েছে, কংস বণিক সম্প্রদায়ের নিমু দত্ত, ইন্দু দত্ত, মুরারী দত্তদের নেতৃত্বে পুজোর সূত্রপাত ঘটে। 

প্রসঙ্গত, মা অন্নপূর্ণার সঙ্গে গণেশ জননী বিগ্রহের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। এখানেও দেবীর ডানপাশে মহাদেব এবং বামপাশে নারদের অবস্থান। মায়ের কোলে গণেশ বসে থাকেন। মোট পাঁচ দিন ধরে চলে মায়ের আরাধনা। পুজোর শেষ লগ্নে গণেশ জননীর কোলের গণেশকে কোলে নেবার রীতি রয়েছে। যাঁরা নিঃসন্তান দম্পতি রয়েছেন, তাঁরা সন্তান লাভের জন্য পুজোর শেষে গণেশকে নিজের কোলে তুলে নেন। নবদুর্গার একটি রূপও গণেশ জননী।





এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...