প্যারামাউন্ট থেকে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল যে'সব প্রতিষ্ঠান

বিংশ শতক ছিল অগ্নিযুগ। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলা। বিপ্লবীদের দল বুঝতে পেরেছিল, নরমপন্থী আন্দোলন নয়। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই ছিনিয়ে নিতে হবে স্বাধীনতা। বিপ্লবীরা যেমন প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেমেছিল, তেমনই সমাজের বিভিন্নস্তরের মানুষ তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। স্বদেশী-ভাবনা থেকে গড়ে উঠেছিল বহু দেশীয় প্রতিষ্ঠান। যেমন মাস্টার দা, সূর্য সেনের সহযোদ্ধা সুরেশ দে তৈরি করেছিলেন শ্রীলেদার্স, স্বদেশী আন্দোলনের ফসল ছিল গৌরীমোহন দত্তর বোরোলিন, সুলেখা কালি। এ'সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল যারা সরাসরি বিপ্লবীদের সাহায্য করত। বলা ভাল, প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো বিপ্লবীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল।

Paramount

কলকাতায় শরবতের পীঠস্থান বলতেই মনে পড়ে প্যারামাউন্টের কথা। বরিশালের নীহাররঞ্জন মজুমদার ১৯১৮ সালে কলকাতায় এই প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। তখন নাম ছিল প্যারাডাইস। শরবত বিক্রির আড়ালে স্বদেশী কাজ কর্ম চলত। বিপ্লবী সতীন সেনের খাস জায়গা ছিল এটি। এখানে আসতেন বাঘাযতীন, সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো বিপ্লবীরা। গুপ্ত সমিতির কাজ ব্রিটিশের চোখকে ধরা পড়ে গিয়েছিল। পুলিশ এসে বন্ধ করে দেয় শরবতের দোকান। ১৯৩৭ সালে 'প্যারাডাইস', প্যারামাউন্ট নামে যাত্রা শুরু করে।

স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল, হিন্দু কলেজের পাশে গড়ে উঠেছিল পাইস হোটেল; তাই নাম দেওয়া হয় হিন্দু হোটেল। ১৯৪৭-র পর নাম বদলে হয় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। মনোগোবিন্দ পাণ্ডার হোটেলের নিয়মিত খোদ্দের ছিলেন নেতাজি, ঋষি অরবিন্দ-সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী৷ শুধু খাওয়া নয়, ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিতে হোটেলের ভিতর গা ঢাকাও দিয়েছেন তাঁরা৷

১৯১৮ সালে স্টার থিয়েটারের অদূরেই তৈরি হয়েছিল এক চপের দোকান, নাম লক্ষ্মী নারায়ণ সাউ। আজও সে'দোকান সমান তালে জনপ্রিয়। নেতাজীর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অর্থাৎ খেদু স্বদেশীদের পত্রবাহকের কাজ করতেন। বিপ্লবের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা চলত দোকান চত্বরে। বিপ্লবী, গুপ্ত সমিতির বৈঠকের চপমুড়ি যেত এই দোকান থেকেই।

বটকৃষ্ণ পাল, পরাধীন ভারতের অন্যতম বড় ওষুধ ব্যবসায়ী। নিজের আবিষ্কার করা ওষুধের নাম 'এডওয়ার্ড টনিক' রেখে যেমন সাহেবদের আস্থাভাজন হয়েছিলেন, তেমন আড়ালে ব্রিটিশদের সাহায্য করে গিয়েছেন। সরাসরি আন্দোলনে নামতে পারতেন না, ঝুঁকি নিয়ে গোপনে কাজ চালাতেন। শোভাবাজারের বাড়ির ডিসপেনসারি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতেন। রাত বিরেতে সেখানে বিপ্লবীরা আসতেন। বটকৃষ্ণ পাল নিজের হাতে 'ওষুধ' তুলে দিতেন তাঁদের হাতে। কোনোটায় থাকত নাইট্রিক অ্যাসিড, কোনোটায় পটাশ। বোমা বানানোর সরঞ্জাম! ওষুধের দোকান হওয়ায় এ'সব জিনিস মজুত রাখা কোনও অসাধ্য কাজ ছিল না। কিন্তু আড়াল থেকে তিনি বিপ্লবীদের মশালের বারুদ জুগিয়ে গিয়েছেন বরাবর।

স্বাধীনতা এক বা একাধিক সংগঠন, মানুষের আন্দোলনে আসেনি। সমাজের সবস্তরের মানুষ যখন, লড়াইয়ে নেমেছেন, তখনই স্বাধীন সূর্যোদয় দেখেছে দেশ। স্বাধীনতার সলতে পাকা যাঁরা নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন, কেউ হয়ত বিপ্লবীদের খারাব দিয়েছেন, কেউ দিয়েছেন খানিক আশ্রয়, কেউ ওষুধ দিয়েছেন; তাঁরাও স্বাধীনতার সেনানি। তাঁদের কুর্নিশ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...