রান্না পুজো থেকে ছাতা পরব ভাদ্র সংক্রান্তি কী ভাবে উদযাপন করে বাংলা

আজ ভাদ্রের শেষ দিন। বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো শুরুর আগে বাঙালির শেষ উৎসবের দিন হল ভাদ্র সংক্রান্তি। এদিন গোটা বাংলায় নানান উৎসব উদযাপিত হয়। আদতে প্রতিটা সংক্রান্তির বড় বেশি করে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির সামনে এনে দাঁড় করায়।

ভাদ্র সংক্রান্তির দিন দিকে দিকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আরাধনা হয়, কল-কারখানায় সমারোহে এই পুজো হয়। সঙ্গে হয় রান্না পুজো, মনসা পুজো। মা মনসা গ্রাম বাংলার লৌকিক আচারের এক অন্যতম দেবী। রান্না পুজো উপলক্ষ্যে বাড়িতে বিভিন্ন পদ রান্না করা হয়। যা মা মনসাকে নিবেদন করা হয়। সংক্রান্তির পরদিন অরন্ধন। এই দিন হয় বিশ্বকর্মা পুজো। বাড়িতে রান্না হয় না, আগের দিনের বাসি রান্না যা নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করা হয় তাই খাওয়া হয়। পরিবারের মঙ্গলকামনায় অনেক বাড়িতেই উনুন জ্বলে না।

ma manasha ranna pujo

রান্না পুজো দু'ভাবে হয়, ইচ্ছা রান্না এবং বুড়ো রান্না। ভাদ্র মাসের যেকোনও মঙ্গলবার বা শনিবার ইচ্ছা রান্না পুজো হয়। বুড়ো রান্না পুজো হয় ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন। অরন্ধন ব্রতে জলে ভেজানো ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ রান্না করার রেওয়াজ রয়েছে। এছাড়াও ওলভাজা, টক, কচুশাকের তরকারি রান্না হয়। বাসি ভাত, তরকারি, মাছকে প্রসাদ হিসেবে খাওয়া হয়। উত্‍সবের প্রধান উদ্দেশ্য হল, ভাদ্র মাসের রান্না আশ্বিন মাসে খাওয়া-দাওয়া। কেউ কেউ একে আটাশে রান্না বা ধরাটে রান্নাও বলে।

ভাদ্র মাসের আরেক উৎসব হল ভাদু। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। রাঢ় বাংলা, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ও লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ভাদু হল লোক-উৎসব। ‘ভাদ্র’ মাস থেকে ভাদু শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন, ভাদু মানে লক্ষ্মী। একে কন্যা পুজো অর্থাৎ মাতৃ আরাধনার ধারাপাতে ফেলা যেতে পারে। বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় ভাদুর জন্য পেল্লাই আকারের জিলিপি বানানো হয়। মেলা বসে। জিলিপির আকার নিয়েও দ্বৈরথ হয়।

বৃহত্তর মানভূম অঞ্চলে ভাদ্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় ছাতা পরব।
"জয়পুরের রাস পূর্ণিমা
বরাবাজারের ইঁদ রে
কাশীপুরের দুগ্গাপূজা
চাকলতোড়ের ছাতা রে
মেলা দেখিতে লোক চলে কাতারে কাতারে"

প্রায় ৫০০ বছর যাবৎ প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ দিন, ৩১ ভাদ্র, অনুষ্ঠিত হয় ছাতা-পরব। পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্যদের হাতে এক সুবিশাল সাদা ছাতা খোলার মধ্যে দিয়ে আজও এ উৎসবের সূচনা হয়। বলা হয় ছাতাটি ইন্দ্রদেবের ছাতা। শালকাঠের খুঁটির মাথায় বাঁশের গোলাকার খাঁচা তৈরি করে কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। ছাতা উত্তোলনের জায়গাকে বলা হয় ছাতাটাঁড়। এই দিন রাজা ঘোড়ার পিঠে চড়ে, রাজবেশে ছাতাটাঁড়ে আসেন। পুরোহিত ইন্দ্রদেবের পুজো করেন। তারপর রাজা আনুষ্ঠানিকভাবে ছাতা উত্তোলন করেন। পরদিন ছাতা নামানো হয়।

ধর্মীয় কাহিনি অনুযায়ী, জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ রোহিণী নক্ষত্রে ইন্দ্রের মর্ত্যে আগমন ঘটে। ভাদ্রপূর্ণিমার দিন তিনি স্বর্গে ফিরে যান। ন’দিন পর কৃষ্ণ অষ্টমীতে ইন্দ্রদেবের সম্মানে ছাতা তোলা হয়। যা ছাতা-পরব নামে পরিচিত। এটি আদপে শস্য-উৎসব। পুরুলিয়ার টামনায়, চাকলতোড় ছাতার মাঠে ফি বছর ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয় ছাতা পরব। মেলা বসে। চাকলতোড় রাজ পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের কোনও একজন প্রতিনিধি এসে শাল গাছের খুঁটির উপর বিশাল সাদা ছাতা তোলেন। দূর-দূরান্ত মানুষ আসেন সামিল হতে। ভেজা ভাদ্র কাটিয়ে আশ্বিন আসবে আগামীকাল। উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...