ধনীর ইচ্ছেতেই উৎসবের জন্ম। কলকাতার এক ধনী কেউকেটা গোছের লোক চৈত্রে রাস উদযাপন করতেন। ভদ্রলোকের নাম নিমু গোসাঁই। আহিরিটোলার সেই নিমাইচরণ গোস্বামী ওরফে নিমু গোসাঁই চৈত্র মাসের রাসে আলোয় মুড়ে ফেলতেন নিজের বাড়ি। গাদাগুচ্ছের বাঁশ দিয়ে আলোকস্তম্ভ বানানো হত। তা নিয়ে আবার খোঁচা দিয়ে ছড়াও বাঁধা হয়েছিল।
'জন্ম মধ্যে কর্ম নিমুর চৈত্র মাসে রাস।
আলোর সঙ্গে খোঁজ নাইক বোমা বোঝা বাঁশ।।'
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বারোদোলের মেলাও ঠিক তাই। উলাগ্রামের (অধুনা বীরনগর) দেবী হলেন উলাইচণ্ডী৷ তিনি উপর শিলাখণ্ড রুপে বিরাজমানা৷ এই দেবীর বার্ষিক পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। এই মেলায় সববর্ণের মানুষ বলে, মেলার নাম হয়েছিল জাতের মেলা৷ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় রানি বায়না ধরলেন মেলায় যাবেন। মহারাজ সে'কথা বেমালুম ভুলে যান। জাতের মেলা দেখা শোভনীয়ও ছিল না রানির জন্য। রানি রাগ করে বসেন। রাজমহিষীর মান ভাঙাতে রাজা মেলা বসিয়ে ফেলেন রাজবাড়ির মাঠে। সেই মেলাই বারোদোলের মেলা। তবে মেলা শুরু দিনক্ষণ জানা যায় না নির্দিষ্ট করে। তবে ১৭৫২-র আগে নয়। কারণ, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের লেখা অন্নদামঙ্গলে বারোদোলের উল্লেখ নেই। রায়গুণাকর ১৭৫২ সালে অন্নদামঙ্গল লেখেন। তারপরেই প্রথম বারোদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
কেবল আবদার রাখতেই মেলা নয়। মেলা শুরুর আগে কৃষ্ণচন্দ্র হয়ত শাস্ত্রজ্ঞদের মত নিয়েছিলেন। ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে এই দোলের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম।
দোলরূঢ়ং সমভ্যরচ্য মাসমান্দোলয়েৎ কলৌ।।
চৈত্র মাসে শুক্লা একাদশী তিথি থেকে এক মাস নৃত্যগীত সহকারে দেবদেবী বিগ্রহকে পূজার্চনা করে দক্ষিণমুখী করে দোলনায় দোলাতে হয়। গরুড় পুরাণেও এর উল্লেখ রয়েছে।
নদিয়ারাজ শাস্ত্র মেনেই সূচনা করেছিলেন বারোদোল উৎসবের। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই নাম বারোদোল। নদিয়ার রাজবাড়ির কুলবিগ্রহ হল বড় নারায়ণ। বড় নারায়ণের সঙ্গে বারোদোলে আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ থাকে। সব মিলিয়ে মোট তেরোটি বিগ্রহ থাকে। তাঁরা হলেন বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, লক্ষীকান্ত, ছোট নারায়ণ, ব্রক্ষণ্যদেব, গড়ের গোপাল, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, নদিয়া গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রী গোবিন্দদেব ও মদনগোপাল। বিগ্রহগুলি বিরহী, শান্তিপুর, সূত্রাগড়, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, তেহট্ট, বহিরগাছি প্রভৃতি স্থানের। এখন আর সব বিগ্রহ রাজবাড়িতে আসে না। তেহট্টের কৃষ্ণরায় বিগ্রহ আসা বহুদিন আগে বন্ধ হয়েছে। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের বিগ্রহও পাঠানো হয় না। তাই গোপীনাথের বিগ্রহের বদলে এখন বিগ্রহের ফটো রাখা হয়।
বিধুভূষণ সেনগুপ্ত রচিত কবিতায় বারোদোলের বিগ্রহগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।
'বিরহীর বলরাম, শ্রী গোপীমোহন
লক্ষীকান্ত বহিরগাছি গুরুর ভবন
নারায়নচন্দ্র ছোট ব্রহ্মণ্যদেব সহ
আর বড় নারায়ণ রাজার বিগ্রহ
গড়ের গোপাল পেয়ে স্থান শান্তিপুর
অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ স্থানে ঘোষঠাকুর
নদিয়ার গোপাল তবে নবদ্বীপে স্থান
ত্রিহট্টের কৃষ্ণরায় অগ্রে ফল পান
অতঃপর কৃষ্ণচন্দ্র, গোবিন্দদেব আর
উভয় বিগ্রহ স্থান আবাস রাজার
মদনগোপাল শেষে বিরহীতে স্থিতি
বারোদোলে তেরো দেব আবির্ভূত ইতি
হেরিলে দেবেরে হরে আধি ব্যাধি ক্লেশ
রাজবেশ ফুলবেশ রাখালের বেশ
ভক্তিভরে দেবনাম করিলে কীর্তন
সকল পাতক নাশে শান্তি লভে মন
ইতি চৈত্র শুক্লপক্ষে শ্রীমন নদীয়াধীপস্য
প্রাসাদোদ্যানে বারদোলাবির্ভূতনাং দেববিগ্রহানাং'
বারোদোল উপলক্ষ্যে ১২টি মন্দির থেকে বিষ্ণুর দ্বাদশ বিগ্রহ এনে রাজবাড়িতে সাড়ম্বরে পুজো করার ব্যবস্থা করেন। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে এক মাস ধরে মেলা বসে। দাবি করা, বিগ্রহগুলি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই বিভিন্ন স্থানে মন্দির নির্মাণ করে স্থাপন করেছিলেন৷ (যা পুরোপুরি সত্য নয়। কিছু কিছু মন্দির তিনি সংস্কার করেছিলেন। কয়েকটি বিগ্রহ তাঁরই স্থাপন করা।) বারোদোলের সময় তিন দিনের জন্য আনা হয়। তিন দিনে দেবতাদের তিনরকম সজ্জা। প্রথম দিন রাজবেশ, দ্বিতীয় দিন ফুলবেশ আর তৃতীয় দিন রাখালবেশ। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সুবিশাল ঠাকুর দালানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ গড়া হয়