আজ অন্নপূর্ণা পুজো,"ওঁ সায়ুধায়ৈ সবাহনায়ৈ সালঙ্কারায়ৈ সপরিবারায়ৈ ওঁ হ্রীং অন্নপূর্ণায়ৈ পরমেশ্বর্য্যৈ নমঃ॥"
পার্বতীর অন্য এক রূপ হলেন দেবী অন্নপূর্ণা। তিনি অন্নদা নামেও পরিচিতা। অন্ন কথার অর্থ ধান, আর পূর্ণা অর্থাৎ পূর্ণ। অর্থাত্ যিনি অন্নদাত্রী। শক্তির অপর রূপ হিসেবে এই দেবীর আরাধনা করা হয়। অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা। গাত্রবর্ণ ঈষৎ রক্তাভ। স্তনভারনম্রা। দেবীর বামহাতে থাকে সোনার অন্নপাত্র। ডানহাতে দর্বী অর্থাৎ চামচ বা হাতা। মাথায় বিরাজিত অর্ধচন্দ্র। তিনি ক্ষুধার্ত মহাদেবকে অন্নদান করছেন স্মিতহাস্যে। পুরাণ মতে চৈত্রমাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে কাশীতে আভির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী। সেই সূত্রে এই তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়। আগমবাগীশের তন্ত্রসার গ্রন্থে অন্নপূর্ণা পুজোর বিশদ বিবরণ রয়েছে। অন্নদার মাহাত্ম্যগাথা নিয়ে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন। দ্বিভুজা অন্নপূর্ণার এক হাতে অন্নপাত্র ও অন্য হাতে হাতা থাকে। দেবীর একপাশে থাকেন ভূমি ও অন্যপাশে থাকেন শ্রী। দেবী অন্নপূর্ণার মাথায় থাকে নবচন্দ্র। বাসন্তী পুজোর অষ্টমী তিথিতে অন্নপুর্ণার পুজা করা হয়। কালী ও জগদ্ধাত্রী পুজোর মতই তান্ত্রিক মতে এই পুজো হয়ে থাকে।
হিন্দু নানা পুরাণ ও গ্রন্থে দেবী অন্নপূর্ণার উল্লেখ রয়েছে। নানা কাহিনীও আছে দেবী অন্নপূর্ণা নিয়ে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ব্যাস কাশী প্রতিষ্ঠার উপাখ্যান ও কাশী প্রতিষ্ঠার উপাখ্যান। দক্ষিণামূর্তি সংহিতা গ্রন্থে মা অন্নপূর্ণার পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও কাশীতে অন্নপূর্ণা পূজা ও অন্নকূট পালন।
"অন্নপূর্ণে নমস্তুভ্যং নমস্তে পরমম্বিকে।
তচ্চারুচরণে ভক্তিং দেহি দীনদয়াময়ি॥
অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে শঙ্করপ্রাণবল্লভে।
জ্ঞানবৈরাগ্যসি...
পুরাণ মতে, বিয়ের পর কৈলাশ পর্বতে শিব ও পার্বতী সুখেই দাম্পত্যজীবন কাটাছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জেরে কিছুদিন পর দাম্পত্যকল হশুরু হয়। দারিদ্রতার কারণে দেবীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের মতবিরোধে পার্বতী কৈলাস ত্যাগ করলে মহামারি, খাদ্যাভাব শুরু হয়। ভক্তগণকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য দেবাদিদেব ভিক্ষার ঝুলি নিজ কাঁধে তুলে নেন। কিন্তু কোথাও ভিক্ষে পান না তিনি। তখন দেবাদিদেব শোনেন যে কাশীতে এক নারী সকলকে অন্ন দান করছেন। দেবীকে চিনতে মহাদেবের একটুও দেরি হয় না। মহাদেব দেবীর কাছে ভিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ভক্তরা মহামারি ও খাদ্যাভাব থেকে রক্ষা পায়। এরপর দেবীর মহিমাবৃদ্ধির জন্য কাশীতে একটি মন্দির স্থাপন করেন শিব। চৈত্রমাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে সেই মন্দিরে দেবী অবতীর্ণ হলেন। সেই থেকেই দেবী অন্নপূর্ণার পুজো প্রচলন হয়।
"ওঁ রক্তাং বিচিত্র-বসনাং নবচন্দ্রচূড়ামন্নপ্রদাননিরতাং স্তনভারনম্রাম্।
নৃত্যন্তমিন্দুশকলাভরণং বিলোক্য হৃষ্টাং ভজে ...
অন্নপূর্ণা পুজো বাংলার একটি প্রাচীন পুজো। কাশী থেকে বাংলায় এই পুজোর প্রচলন হয়, বাংলার সঙ্গে কাশীর যোগাযোগ বহুকালের। বিশ্বনাথের ধাম, বাঙালির বার্ধক্যের কাশী। কাশীই হল মা অন্নপূর্ণার অধিষ্ঠানক্ষেত্র। শৈব ও শাক্ত-সংস্কৃতির অপূর্ব মিলনস্থল।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণের কাশীখণ্ড দেবীভাগবতে ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে কাশীর অন্নপূর্ণা সম্পর্কে নানান কাহিনী রয়েছে। কাশীপ্রতিষ্ঠার কাহিনীর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছেন দেবী । লোককথা অনুসারে, শিব আদপে ভিক্ষুক। রোজগারের ক্ষমতা নেই তাঁর, গৌরী তাঁর সংসারে এসে আকুল পাথারে পড়েছেন। এই নিয়েই শিব-দুর্গার ঝগড়া। ক্ষোভে দুঃখে গৌরী একদিন চলে গেলেন বাপের বাড়ি। জয়া-বিজয়া পরামর্শ দিলেন যে ভিখিরি শিবকে জব্দ করতে হবে। দেবী জগতের সমস্ত অন্ন হরণ করলেন। শিব তখন খিদের জ্বালায় কাবু। যেখানেই যাচ্ছেন কোথাও অন্ন নেই! শেষে লক্ষ্মীর পরামর্শে কাশীতে এলেন শিব। অন্নপুর্ণার হাত থেকে অন্ন খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। কাশীতে স্বয়ং মহাদেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। সেই থেকে চৈত্র শুক্লাষ্টমীতিথিতে শুরু হল দেবীর পুজো। এইভাবে কালক্রমে কাশীর দেবী অন্নপূর্ণা হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে।
বাংলার লৌকিক ইতিহাস মতে, দেবী অন্নপূর্ণার পুজো বঙ্গদেশে প্রচলন করেছিলেন বাংলার বার ভুঁইয়াদের অন্যতম ভবানন্দ মজুমদার। দেবী অন্নদার কৃপায় ভবানন্দ মজুমদার জাহাঙ্গীরের কাছে রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন। কিন্তু অন্নদামঙ্গলে রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের কাছে নির্ধারিত দিনে কর বা রাজস্ব মেটাতে না পেরে দুর্গাপুজোর সময় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদে কারারুদ্ধ হন। সেই সময়ে দেবী অন্নপূর্ণা রাজাকে দর্শন দিয়ে তাঁর মূর্তি পুজো করতে বলেছিলেন। নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায় যে অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অনস্বীকার্য।
নবান্নের সময় অন্নপূর্ণা পুজোয় আদৌ বলি বা ষোড়শোপচারে পূজা হয় না। মূলত শ্রমজীবী মানুষেরাই এই দেবীর পুজো নিয়ে আসেন। অন্যদিকে চৈতি অন্নপূর্ণার পুজো হয় বনেদি বাড়িতে বা জমিদার মহল, শাক্ত মতে পুজো চলে। অন্নপূর্ণার প্রাচীন মন্দির ব্যারাকপুরে রয়েছে। রানি রাসমণির কন্যা জগদম্বা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, অবিকল দক্ষিণেশ্বরের মতো এই মন্দির। শেওড়াফুলি রাজবাড়িতেও অন্নপূর্ণা দেবী পুজো পান। মুর্শিদাবাদ জেলার কাগ্রামে রায়চৌধুরী পরিবারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার অম্বিকালাল চৌধুরীর স্ত্রী রামাসুন্দরী দেবী একবার দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেই পুজো আজও চলে আসছে।
সুকুমার সেনের মতে, দেবী অন্নপূর্ণা গ্রিক ও রোমান দেবী ‘অন্নোনা’র রূপান্তর। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের রোম সম্রাট টিটাসের রাজত্বকালে একটি মুদ্রায় এই অন্নোনার মূর্তি খোদিত আছে। দেবীর বামহাতে শিঙ্গা আর ডানহাতে তুলাদণ্ড। অন্যমতে, এই শস্যদেবী আসলে হরপ্পা যুগের শাকম্ভরীর মতো একান্তই ভারতীয় দেবী।
অন্নপূর্ণা শস্যদেবী। জনশ্রুতি রয়েছে, মা অন্নপূর্ণা সন্তুষ্ট হলে গৃহে কখনও অন্নের অভাব ঘটে না। সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাঢ় বাংলায় নবান্ন উৎসবের সময় এই অন্নপূর্ণার পুজো হয়ে আসছে। আজও গ্রামে গ্রামে নতুন ফসল তোলার পরই দেবীর হাতে ধানের পাকা শিষের দিয়ে পুজো হয়। কাশীর অন্নপূর্ণার সঙ্গে যার গভীর মিল রয়েছে। কাশীর মন্দিরেও পাকা ধানের গুচ্ছ বা শষ্য দিয়ে দেবীর পুজো-অর্চনা হয়। বঙ্গদেশে সাধারণ মানুষ অন্নপূর্ণার পুজো করেন অগ্রহায়ণ মাসের নবান্নের সময়। এটি প্রাচীন পুজো যা পরবর্তীকালে প্রবাসী বাঙালিদের হাত ধরেই কাশীতে প্রবেশ করেছিল। দেবী অন্নপূর্ণা মূলত রাঢ়-বঙ্গের দেবী। এক সময় বাঙালিরাই এই দেবীর পুজো কাশীতে নিয়ে গিয়েছিলেন।