আকাশ বাড়ি

আমাদের প্রত্যেকেরই বোধহয় ছোটবেলায় আকাশ নিয়ে একটা কল্পনা থাকে। মহাজাগতিক কিছু সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাক বা নাই থাক, দিনের বেলার ওই প্রখর রৌদ্রের তেজ, পাশাপাশি রাতের আকাশের স্নিগ্ধতা আমাদের অপার বিস্ময়ের জগতে নিয়ে যায়। চাঁদ-তারা ভরা আকাশ মনের মধ্যে কল্পনার জগৎটাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় অজানা কোনো জগতে। তাই ছোটবেলায় আমরা সবাই হয়ত আকাশটাকেই মহাকাশ হিসেবে জানি এবং ভাবি বড় হয়ে মহাকাশে যাব। কিন্তু কিছু মানুষের সেই ইচ্ছা বাস্তবে পরিণত হয়, কারোর আবার বড় হতে হতে ইচ্ছাটাই পাল্টে যায়। তবে আপনারা কি জানেন, মহাকাশে যেতে গেলে বা বলা ভালো, মহাকাশচারী হতে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট করতে হয়, প্রচুর মনের জোর এবং শরীরের জোর না থাকলে কিন্তু আপনি মহাকাশ নিয়ে পড়াশুনো করলেও বাস্তবে মহাকাশে যেতে পারবেন না। বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজগুলির একটি হল এই মহাকাশচারী হওয়া। আজকে আমরা একটু সেই বিষয়ে আলোকপাত করি, জানি ঠিক কেমন প্রস্তুতি নিতে হয় মহাকাশচারী হওয়ার জন্য।

    নাসার কাছে মহাকাশচারী হওয়ার জন্য প্রচুর দরখাস্ত জমা পড়ে। তার মধ্যে থেকে এক ছটাক মানুষকে ছেঁকে নেয় নাসা তাদের চূড়ান্ত যাত্রার যাত্রী হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতি ৬০০০ বিজ্ঞানীর মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন মাত্র ৮ জন বিজ্ঞানী মহাকাশযানের যাত্রী হিসেবে। তার ওপর রয়েছে সেখানে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়, আর নিজের জায়গায় অর্থাৎ পৃথিবীতে ফেরাও হয় না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা হতে পারে বলে তাঁদের জন্য প্রচুর অর্থের বীমা করানো হয়। তাঁরা যাবার আগে উইল করে যান বা পরিবারের লোকজনদের সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে যান।

  • মহাকাশে যাওয়ার আগে প্রত্যেক মহাকাশচারীর আলাদা আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া থাকে। মহাকাশে তাদের প্রতি মিনিটের কাজ ভাগ করে দেওয়া থাকে। সেই মত কাজ না হলেই কিন্তু সমস্যা তৈরী হতে পারে। প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর প্রত্যেককেই নাসার পৃথিবীস্থিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কাজের রিপোর্ট পাঠাতে হয় অথবা ভিডিও ইন্টারভিউ দিতে হয়। সেখানে কেউ গবেষণার কাজ করেন কেউ বা করেন মহাকাশযানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। কখনও কখনও আবার স্পেস ওয়াক-ও করতে হয়।
  • জানেন, মহাকাশযানে ভাসতে ভাসতে আপনি প্রতি মুহূর্তেই দেওয়ালে ধাক্কা খাবেন। তাই প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়, একটু অসতর্ক হয়ে গেলেই মাথায় গুরুতর আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে।
  • মহাকাশে অভিকর্ষ না থাকার কারণে মহাশচারীদের উচ্চতা দুই ইঞ্চি বেড়ে যায়। পৃথিবীতে ফেরার পর তা আবার কমে গিয়ে আগের জায়গায় এসে যায়।
  • মহাকাশচারীদের ক্ষুদ্রান্তে থাকা ব্যাকটেরিয়া দাহ্য গ্যাস তৈরী করতে পারে। তাই দেহে উৎপন্ন বায়ুত্যাগের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। ভাবুন একবার, কিভাবে নিজেকে সামলে চলতে হয়। স্পেস স্যুটে স্পেশাল ফিল্টার লাগানো আছে, যেটি দাহ্য গ্যাস ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দেয়।
  • অনেকেই হয়ত জানেন, আমাদের পা আমাদের শরীরের ভার বহন করে। এই ভার সামলানোর জন্য আমাদের পায়ের হাড় আর পেশী শক্ত হয়। কিন্তু মহাকাশে শূন্যে ভেসে থাকতে হয় বলে পায়ের ব্যবহার থাকেনা। এর ফলে তাদের কোমরের পেশী ও পায়ের পেশী ক্রমশ ক্ষমতা হারাতে থাকে। হাড় ক্ৰমশ পাতলা ও দুর্বল হয়ে যায়। তাই মহাকাশচারীদের দু'ঘন্টা রোজ ব্যায়াম করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে নাসা।
  • মানুষের হৃৎপিন্ড ও রক্তেরও পরিবর্তন ঘটে মহাকাশে গেলে, আমরা যখন দাঁড়াই, মাধ্যাকর্ষণের টানে রক্ত পায়ে নেমে যায়। কিন্তু মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ নেই, ফলে রক্ত মাথায় উঠে আসে, মুখ ফোলা ফোলা লাগে, ব্রেনে ভীষণ চাপ পড়ে।
  • মহাকাশে কিন্তু ডাক্তার সঙ্গে যায়না। তাই সেখানে শরীর খারাপ হলে মুশকিল। যদিও সিলেক্টেড মহাকাশচারীদের হাফ ডাক্তারি শিখিয়েই পাঠানো হয়। কিন্তু আতংক তো সঙ্গে থাকেই, যাতে বড়োসড়ো কোনো সমস্যা না হয়।
  • ঘুম থেকে উঠেই মহাকাশচারীরা আমাদের মতনই ব্রাশ করেন, এবং প্রাকৃতিক কাজ সেরে ফেলেন। প্রত্যেকের নিজস্ব টুথব্রাশ, চিরুনি পেস্ট, শেভিং মেশিন থাকে একটি হাইজিন কিটে। সেখানে কোনো বেসিন থাকেনা। জলের কল তো থাকেই না। ব্রাশ করার পর তাই আমাদের মত কুলকুচি করেন না তাঁরা। ভেজা টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে নেন।
  • মহাকাশে স্নানের পদ্ধতিও ভিন্ন রকম। বিশেষ সাবান আর শ্যাম্পু ব্যবহৃত হয়। ফেনাযুক্ত এই সাবান ধুতে হয়না। ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছে নিতে হয়। কিন্তু খুব সাবধানে স্নান করতে হয়, যাতে সাবানের ফেনা গা থেকে ছড়িয়ে না যায়। তাহলেই ঘটবে বিপত্তি।
  • মহাকাশে জিরো গ্রাভিটি টয়লেট থাকে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার লাগানো কমোড ব্যবহার করা হয়। মহাকাশচারীরা মূত্রত্যাগ করেন আলাদা ভ্যাকুয়াম টিউবে। মূত্রকে ফিল্টার মেশিনের সাহায্যে আবার শুদ্ধ জলে পরিণত করা হয়। ভাবুন একবার!
  • স্পেস স্টেশনে জল খাওয়ার জন্য বা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমান জল নিয়ে যাওয়া হয়। জলের অপচয় রুখতে বিশেষভাবে নির্মিত ওয়াটার পাউচ ব্যবহার করেন মহাকাশযাত্রীর। যে পাউচে চাপ দিলে ফোঁটা ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে।
  • মহাকাশযান খুবই ছোট হয় বলে সব সময় তা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হয়। জীবাণুনাশক সাবান ব্যবহার করে মহাকাশযানের জানালা, দেওয়াল ও মেঝে প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হয়। তাঁদের খাবার ট্রে, কাঁটা চামচও তারা সবসময় পরিষ্কার রাখেন। চারটে ডাস্টবিন থাকে। তিনটে শুকনো আবর্জনা ও একটা ভিজে আবর্জনা ফেলার জন্য।
  • ওঁরা কিন্তু আমাদের মতোই তিন বেলা খাবার খান। সেই খাবার মহাকাশযানে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক হিসেবে করে। কারণ মহাকাশে খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং সেই খাবার ভালো রাখতে নাসার লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ হয়। তাই প্রত্যেক মহাকাশচারীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমান খাবার নিয়ে যাওয়া হয়। নাসার গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার পর খাবার মহাকাশযানে ওঠে। স্পেস স্টেশনে ফ্রিজার থাকেনা। তাই শুকনো খাবার রাখা হয় সেখানে। তবে ইদানিং অবশ্য পাস্তা, নুডলস, ম্যাকারনি, পিৎজা, বার্গার, ফল, চিকেন, চকোলেট, বাদাম, মাখন সব খেতে পারেন মহাকাশচারীরা। এখনকার মহাকাশযানে রান্নাঘরও থাকে যেখানে গরম জল ও বৈদ্যুতিক ওভেন আছে। খাবার গরম করেও খেতে পারেন তাঁরা। তবে গুঁড়ো কিছু দেওয়া হয়না। নুন, গোলমরিচ দেওয়া হয় তরল আকারে।
  • মহাকাশে যেহেতু উপর-নীচ বোঝা যায় না তাই যেভাবে খুশি ঘুমোনো যায়। তবে ঘুমোনোর আগে মহাকাশচারীরা নিজেদের বিছানার সঙ্গে বেল্ট দিয়ে বেঁধে নেন। মহাকাশচারীদের কেবিনগুলিতে গান শোনার এবং হালকা আলোর ব্যবস্থা থাকে। তাঁদের প্রতিদিন ৮ ঘন্টা করে ঘুমোনো বাধ্যতামূলক। এই সমস্ত কাজ কিন্তু সব ঘড়ি ধরে হয়। সব কিছুই কাঁটায় কাঁটায় করতে হয়।
  • তবে একটা কথা, মহাকাশচারীদের কিন্তু আমাদের মতোই সপ্তাহে দু'দিন ছুটি থাকে। ছুটির দিনগুলিতে তাঁরা পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলেন, গান শোনেন, নিজেরাও কখনো গান-বাজনা করেন, তাস খেলেন বা বই পড়েন বা নিখাদ আড্ডায় মেতে ওঠেন। মহাকাশযানের ছোট ছোট জানলা দিয়ে পৃথিবীকে দেখেন। স্পেস স্টেশন পৃথিবীতে ৪৫ মিনিট পর পর ঘুরে আসে বলে সেখানে থাকা মহাকাশচারীরা ২৪ ঘন্টায় অনেকবার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পান। এগুলিও তাদের অন্যতম বিনোদন।

    এইভাবে মহাকাশচারীরা আমাদের জন্য মহাকাশের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেন নিজেদের জীবনের আত্মত্যাগের মাধ্যমে।

    

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...