জোড়া ভ্রু। পাতলা ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা স্পষ্ট। মাথায় একরাশ গাঢ় রঙের ফুল। উজ্জ্বল সাজগোজ। দু হাতের আঙুল ঘিরে থাকা অঙ্গুরীয় চোখ টেনে নেয় সহজেই।আঁকা শিখেছিলেন নিজের চেষ্টাতেই। আঁকার ক্লাসের ধরাবাঁধা সিলেবাসের মধ্যে নয়। তাঁর রং তুলি ধরতে শেখা একেবারে তাঁর নিজের জন্যই।
পুরো নাম ম্যাগদালিনা কারম্যান ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরন। দুনিয়া তাঁকে চেনে ফ্রিদা কাহলো নামে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম মেক্সিকান চিত্রশিল্পী।
জন্ম মেক্সিকো সিটিতে। ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই।
ফ্রিদার বাবা কার্ল উইলহেম কাহলো। পেশায় ফটোগ্রাফার বাবার খুব কাছাকাছি থাকতেন ফ্রিদা। তাঁর স্টুডিয়োতে সহকারীর কাজ করতেন। মেডিকেল সায়েন্স পড়ার জন্য ১৯২২ সালে মেক্সিকোর অন্যতম প্রিমিয়ার স্কুল প্রিপারেটোরিয়াতে ভর্তি হন।
মাত্র ৬ বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হন।একেবারে কাঠির মতো হয়ে যায় ডান পা। ওপর পায়ের পাতায় বাঁক ধরে। স্পাইনা বাইফিডা নামের একধরনের জন্মগত রোগ ছিল, যা তার মেরুদণ্ড আর পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তবে শারীরিক অসঙ্গতি কাবু করতে পারেনি তাঁর অসম্ভব প্রাণশক্তিকে। খাটো পা ঢেকে রাখতেন গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসা লং স্কার্টে।
ফ্রিদার জীবনে আরও বড় আঘাত নেমে আসে তাঁর আঠারো বছর বয়সে। ১৯২৫ সালে একটি বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। লোহার পাত শরীরের মধ্যে ঢুকে এ ফোঁড়- ওফোঁড় হয়ে যায়। শারীরিক আঘাতের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে ত্রিশবার অস্ত্রপ্রচার করতে হয়।
বিছানায় এক ঘেঁয়েমি এবং শারীরিক সংকট ভুলে থাকার জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং-তুলি। অর্ধেক অবশ শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় স্থির। যন্ত্রণা প্রকাশ করে চললেন রং-তুলি ক্যানভাসে। বাবা রং-তুলি উপহার দিয়েছিলেন। মা তৈরি করে দিয়েছিলেন বিশেষ ধরনের ইজেল। যাতে ফ্রিদা শুয়ে শুয়েই আঁকার কাজ করতে পারতেন।
নিজের ক্যানভাসে নিজের ছবি আঁকতেন। ওয়ারিং অ্যা ভেলভেট ড্রেস (১৯২৬) তাঁর সেই সময়ের আঁকা ক্যানভাস। অসুস্থতার অন্ধকার নয় তিনি নিজেকে বারবার দেখতে চাইতেন ভেলভেট রঙ্গিন। তবু বাস্তব পিছু ছাড়ে না। রঙের মধ্যেও ছবির ঘোলাটে ভাব নজর এড়ায় না।
বারবার ভাঙন এসেছে ফ্রিদার জীবনে। কখনও অসুস্থতার জেরে কখনও সম্পর্কের জেরে। যত যন্ত্রণা পেয়েছেন তত আঁকড়ে ধরেছেন ক্যানভাসকে। মেক্সিকান সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন ছবিতে। উজ্বল রঙের ব্যবহারে তা স্পষ্ট। প্রতীকের ব্যবহারে উঠে এসেছে পরাবাস্তববাদ।রেনেসাঁ মাস্টার্স এবং ইউরোপীয় অ্যাভান্ট-গার্ড শিল্পীদের যেমন আমেদিও মোদিগলিয়ানির দ্বারা প্রভাবিত হন।
সারাজীবন বিতর্ক তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তিনি ছিলেন জন্ম বিপ্লবী। নিজেকে সেভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন। চেনা ছকের বাইরে বহমান এক জীবন।
ব্যক্তিগত ডায়েরির সেশ পাতায় লিখেছিলেন, ডায়েরিতে তিনি শেষ যে কথাটি ব্যক্ত করেন তা হচ্ছে, ‘আই হোপ দ্য লিভিং ইজ জয়ফুল, অ্যান্ড আই হোপ নেভার টু রিটার্ন।’
তাঁর জীবনের সারমর্মও এই কথাগুলোই।