কালী কথাঃ জিরাটের সিদ্ধেশ্বরী মন্দির

আজ কালী কথায় আরেক ডাকাত কালীর গল্প, হুগলির জিরাট গ্রাম। এখানেই রয়েছে কেলে ডাকাতের মন্দির। চক্রবর্তী, গোস্বামী ও মুখোপাধ্যায়; এই তিন পরিবারকে কেন্দ্র করেই অবর্তিত হয়েছে এই গ্রাম তথা মন্দিরের ইতিহাস। কালিয়াগড়ের কালী অত্যন্ত প্রাচীন, এর ইতিহাস ঘটনাবহুল। হুগলি তখন ফরাসী ঘাঁটি। তাই ফরাসি শব্দ 'জিরায়ৎ' থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় জিরাট। এখানে অবস্থিত 'গোপীনাথ জীউ' মন্দির প্রতিষ্ঠার পরদিন ভোরেই মন্দির চত্বরে প্রভুর পদচিহ্ন দেখা গিয়েছিল। তাই জীউ এর 'জী', 'রা' অর্থাৎ দান করা এবং 'ট' অর্থ পদ। এটিই হল 'জিরাট' নামের সার্থকতা। হাওড়া-কাটোয়া মেইন লাইনেই জিরাট স্টেশনটির অবস্থান। আজকের এই গ্রাম্য একদা ভয়ের কারণ ছিল। হাড় হিম করা ডাকাতের কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে এই গ্রামে।

জনশ্রুতি রয়েছে, গঙ্গার পশ্চিমপাড় থেকে এক ব্রাহ্মন সন্তান হঠাৎ করে জিরাটে এসে উপস্থিত হন এবং স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বংশ পরম্পরায় তাঁরা মুখোপাধ্যায় হলেও মা কালীর পুজোর অধিকারী ছিলেন বলে তাঁরা অধিকারী পদবি গ্রহণ করেন। এই বংশেরই আদি পুরুষ কাশীনাথ অধিকারী। তাঁর দুই কন্যা গোস্বামী ও চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই পরিবারের সদস্যারা হুগলির ডাচ ও ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করে শুরু করেন এবং ব্যবসায়িক সূত্রে জড়িয়েও পরেন। এই পরিবারের কৃতি সন্তান হলেন বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

মন্দিরের কথায় ফেরা যাক, বাংলায় নানান মতে, কালীর আরাধনা হয়ে থাকে। তারমধ্যে ডাকাত কালী হলেন সর্বশক্তির মূল আধার। ডাকাতির আগে বলি, লাউ পোড়া ইত্যাদি সহযোগে দেবীকে সন্তুষ্ট করা হত। জিরাটে বেশ কয়েকটি কালী মন্দিরের হদিশ মিললেও, কালিয়াগড়ের বা কেলেগড়ের কালীমন্দিরটি বহু পুরোনো।মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায়, এখানে দেবীর হাতের বালা পড়েছিল, তাই এটি লোকমুখে বলয়োপ-পীঠ নামেও পরিচিত। এই কালিয়াগড়েই ছিল জমিদার কালিচাঁদের বিশাল মহল, আবার এখানেই ছিল তার ডেরা। শোনা যায়, কালিচাঁদ নিকষ অন্ধকারে কপালে সিঁদুর লেপে, হাতে অস্ত্র নিয়ে কেলে ডাকাত বেশে ডাকাতি করতে যেতেন। পথযাত্রীদের পথ আটকে চলত লুটপাট। ডাকাতিতে ভর করেই গড়ে উঠেছিল তার জমিদারি সাম্রাজ্য। যদিও বর্তমানে, তার উত্তরপুরুষরা এই জনশ্রুতির সত্যতা স্বীকার করেন না। পুরাণ অনুসারে, দেবী সতীর দেহাংশ যেখানে আছে, সেগুলি শক্তিপীঠ, আর হাতের বালা বা বলয় যেখানে পরেছিল, সেগুলি বলয়োপ-পীঠ।

Sidheswari-kali-mandir

জনশ্রুতি অনুসারে, কালির গড় থেকে এই স্থানের নাম কালিয়াগড় হয়। আবার কারোর কারোর মতে যে ডাকাতের হাতে এই কালি মন্দিরের প্রতিষ্ঠা তার নাম ছিল কেলে ডাকাত এবং তার নাম থেকেই এই স্থানের নাম হয় কালিয়াগড়। তবে সে ঘটনার, কোনও প্রামান্য ইতিহাস নেই। কিন্তু লোকমুখে এই মন্দির ডাকাত কালী মন্দির হিসাবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। জনশ্রুতির কতটা সত্য আর কতটা মানুষের কল্পনার ফসল তা বিচার করার উপায় নেই!

একদা এই জিরাটের নাম ছিল মহম্মদপুর। তখন এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। মন্দিরের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে যেত গঙ্গা নদী। যদিও বর্তমানে খালি চোখে দেখে নদীর অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। কালের নিয়মে গঙ্গা তার গতিপথ বদলালেও, এককালে যে গঙ্গা এই পথেই ছিল মন্দির সংলগ্ন ঘাটে নামার সিঁড়ি দেখে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিছু বছর অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করানো হয়, প্রাচীন মূল কাঠামোটি আজও অক্ষত। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর দেবী অধিষ্ঠিতা। দেবীর পুজো হয় তন্ত্রমতে। বর্তমানে বলি বন্ধ হয়েছে, তবে বিশেষ অনুষ্ঠান বা মানত উপলক্ষ্যে বলি হয়। সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরের পাশেই রয়েছে কালভৈরবের মন্দির।

Sidheswari-kali-mandir-01

কালী ডাকাতের নাম লোক মুখে নাকি হয়ে যায় কেলে ডাকাত। জিরাটের কালীগড়ের কালীর সঙ্গে কালী ডাকাত ও তার সঙ্গীদের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এই জমিদার কালীই কেলে ডাকাত ছিলেন কিনা সেনিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। আবার একদল গবেষকদের মতে কালীগড় থেকেই নাকি এই এলাকার নাম হয় কেলেগড় বা কালিয়াগড়। তবে লোকবিশ্বাস, কালী বা কেলে ডাকাতের নাম থেকেই নাকি এলাকার নাম হয়েছে কেলেগড়। কেলে ডাকাত এলাকায় জনদরদী সজ্জন হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় জমিদার কালিচাঁদ ছলেন অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। রাতের অন্ধকারে তিনি নাকি ডাকাতি করতেন।জমিদার কালাচাঁদ রাতের অন্ধকারে হয়ে যান কেলে ডাকাত। জমিদার কালাচাঁদের প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দির। কালিরগড় থেকে এই স্থানের নাম কালিয়াগড় হয়। কেলে ডাকাতের নাম থেকেই নাকি এলাকার নাম হয় কালিয়াগড়।

কালী ডাকাতের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে আজও পুজো পাচ্ছেন মা কালী। বর্তমানে সেই ডাকাতি হুঙ্কার কিংবা হাড়হিম করা ভয় না থাকলেও, বেশ কিছু স্মৃতি আজও অক্ষত। তারমধ্যে কেলেগড়ের কালীমন্দির তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...