তেলিনীপাড়ার অন্নপূর্ণা মন্দির

অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবে বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রসার ঘটেছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন। পরবর্তী কালে কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় অন্নপূর্ণা পুজো। তবে, বাংলায় অন্নপূর্ণার মন্দির বিরল। দেবী অন্নপূর্ণা শস্যদায়ীনি দেবী। রানী রাসমণির কন্যা বারাকপুরে অন্নপূর্ণা মন্দির তৈরি করেছিলেন। তা আমাদের সকলেরই জানা। আজ আরেক অন্নপূর্ণা মন্দিরের কথা বলব আপনাদের। শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির, গঙ্গার ওপারে হুগলির ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়ায় অবস্থিত। এটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন এবং বিখ্যাত অন্নপূর্ণা মন্দির। চন্দননগরের পাশে ও শ্যামনগর শহরের বিপরীত তীরের গঙ্গার ধারেই এই মন্দির অবস্থিত। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে ভদ্রেশ্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভদ্রেশ্বর অতি প্রাচীন এক জনপদ। তেলিনীপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বন্দোপাধ্যায় ১৮০১ সালে, বাংলার ১২০৮ বঙ্গাব্দে ফাল্গুণ মাসে দোলপূর্ণিমা তিথিতে অন্নপূর্ণা মায়ের মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হাওড়া-ব্যান্ডেল লাইনের ভদ্রেশ্বর স্টেশন নেমে সহজে মন্দিরে চলে আসা যায়।​ জিটি রোড থেকে এই মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়। ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়ার বাবুবাজারের ফেরিঘাট স্ট্রিটে অন্নপূর্ণা মন্দির অবস্থিত।  

দক্ষিণেশ্বরের মতোই, এই মন্দিরটিও নবরত্ন নির্মাণশৈলী অনুযায়ী নির্মিত। যদিও বাংলার চিরাচরিত নবরত্নশৈলী থেকে কিছুটা ভিন্ন। মন্দিরের ছাদের উপরেই প্রথম ধাপে চারটি রত্ন বা চূড়া রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপেও চারটি রত্ন, তবে দ্বিতীয় ধাপের চূড়াগুলি; প্রথম ধাপের তুলনায় আকারে খানিক ছোট। সর্বোচ্চ অর্থাৎ তৃতীয় ধাপের একটিমাত্র চূড়া রয়েছে। প্রথমধাপ চূড়াগুলির মতোই সর্বোচ্চটির আকার। ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণেই নবরত্নগুলি স্থাপিত। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। নবরত্নটির প্রথম তলের চার কোণে চারটি শিখর  এবং দ্বিতলের চার কোণে চারটি প্রথম তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট শিখর রয়েছে। তাদের মাঝখানে মূল রত্নটি অবস্থিত। দ্বিতীয় তলের কক্ষটিতে বঙ্গীয় স্থাপত্যরীতি অনুসারে তিনটি খিলানের জন্য দূর থেকে মন্দিরটিকে গাম্ভীর্যমণ্ডিত মনে হয়। মন্দিরের সম্মুখভাগে পত্রাকৃতি ত্রিখিলানের পরিবর্তে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতি অনুসারে স্তম্ভের ব্যবহার করা হয়েছে।

মন্দিরের গর্ভেগৃহে কাঠের সিংহাসনের উপরে অষ্টধাতুর নির্মিত দেবী অন্নপূর্ণার বিগ্রহ অবস্থান করে। অন্নদানে রতা মাতৃমূর্তি। তাঁর ডান হাতে অন্নদান করার হাতা এবং বাম হাতে অন্নপাত্র। দেবীর পুজো হয় তন্ত্র মতে। দেবীকে ভোগে প্রতিদিন মাছ দেওয়া হয়। আগে এখানে মোষ বলি দেওয়া হত। এখন কোন পশু বলি দেওয়া হয় না। দেবীর ডানপাশে রয়েছেন মহাদেব। তার বিগ্রহ রৌপ্য নির্মিত। দেবাদীদেব মহাদেবের বাম হাতে সিঙ্গা ও ডমরু এবং ডান হাতে ভিক্ষাপাত্র। এছাড়া মন্দিরে লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তি এবং আলাদা করে দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মূর্তি রয়েছে। মন্দিরে নারায়ণশিলাও বিরাজমান। মূল মন্দিরের ডানদিকে তিনটি পৃথক মন্দির রয়েছে। সেগুলি শিব মন্দির। তিনটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে মন্দিরগুলির মধ্যে। আগে এখানে চারটি শিবলিঙ্গ ছিল। এর মধ্যে একটি শিবলিঙ্গ ভেঙে যাওয়ায় তা গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়। 

শ্রী শ্রী অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দিরে দেবী অন্নপূর্ণা এবং অন্যান্য দেবদেবীর নিত্য পুজো হয়। ভোগ নিবেদন করা হয়। অম্বুবাচির চারটি দিন ছাড়া বছরের আর সবগুলো দিনে একই নিয়মে পুজো চলে। অন্নপূর্ণা পুজো এবং শিবরাত্রির সময়ে এখানে বিপুল সংখ্যক ভক্তের সমাগম হয়। এছাড়াও এই মন্দিরে ঝুলন উৎসব, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, দোল পূর্ণিমা, সত্যনারায়ণ পূজা এবং অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বিশেষ রথযাত্রা ইত্যাদি উৎসবগুলি পালিত হয়। 

বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে এই মন্দিরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তেলিনীপাড়ার এই রথযাত্রা এই মন্দির ও ভদ্রেশ্বরের ঐতিহাসিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণা এবং মহাদেবকে পিতলের একটি নবরত্ন রথে বসিয়ে মন্দিরের নিকটস্থ এলাকায় পরিক্রমা করানো হয়। তেলিনীপাড়ার মানুষের মঙ্গলার্থে এই রথ মন্দির থেকে বের হয়ে শহরের প্রতিটি বাড়িতে যায়। আগে রথ গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত গেলেও এখন শুধু বারোয়ারি তলার মোড় পর্যন্ত যায়। বিকেলে ভক্তেরা চতুর্দোলায় লক্ষ্মী নারায়ণকে নিয়ে শিব ও অন্নপূর্ণার রথ মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এই সময়ে ভক্তেরা শিব ও অন্নপূর্ণার কাহিনী নিয়ে পালা কীর্তন গান করেন। শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণার এই রথযাত্রা ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়ার আপামর জনসাধারণের কাছে একটি আনন্দের উৎসব। একমাত্র এই দিনেই ভক্তেরা সবাই অন্নপূর্ণাকে স্পর্শ করতে পারে এবং দেবীর মাথায় সিঁদুর পরাতে পারেন। মন্দিরে ফিরে আসার পরে গভীর রাতে মা অন্নপূর্ণাকে সপ্তসমুদ্রের জল ও অগুরু চন্দনে স্নান করিয়ে নববস্ত্র পরিয়ে গর্ভগৃহের সিংহাসনে পুন:অধিষ্ঠিত করা হয়। 

এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গাপুজোও এক উৎসব। দুর্গাপুজোর সময়ে অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দিরে দশ দিন ধরে দুর্গাপুজো চলে। মহালয়ার দিন পুজো শুরু হয়, বিজয়া দশমীর দিন পুজো শেষ হয়। পুজোর দিনগুলিতে মন্দিরে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেবী দুর্গাও পূজিতা হন। মহাসপ্তমীর দিনে দেবীকে বাহান্ন পদের ভোগ নিবেদন করা হয়। সেইদিন মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে এবং তারা সকলেই মায়ের ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করেন। প্রতিমা বিসর্জন হয় শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দিরের নিজস্ব ঘাটে। কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে মন্দিরে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে সত্যনারায়ণের আরাধনা করা হয়ে থাকে। ফাল্গুণী পূর্ণিমার দোলযাত্রায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠা তিথিতে বিশেষ পুজো হয়।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...