১৯১৯ সালে প্রথম বাংলা ছবি তৈরি হল, 'বিল্বমঙ্গল'। কিন্তু সে ছবিতে কথা ছিল না। ছবির সঙ্গে কথা, শব্দ ও সঙ্গীত জুড়ে দেওয়ার পদ্ধতি তখনও আবিষ্কার হয়নি। দর্শক যাতে বোর না হন, তার জন্য প্রতিটি সিনেমাহলে একটা করে অর্কেস্ট্রার দল থাকতো। তারা ছবির মুড অনুযায়ী লাইভ মিউজিক বাজিয়ে যেত। তারপর ১৯৩১ সালে অমর চৌধুরীর শর্ট ফিল্ম 'জামাই ষষ্ঠী' এবং প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ফুললেন্থ ফিচার ফিল্ম 'দেনাপাওনা' ছবির মধ্যে দিয়ে বাংলা ছবি কথা বলতে শিখল। ছবির সঙ্গে শব্দ ও সঙ্গীত যোগ করা সম্ভব হল। এই সময় বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবন ও ধর্ম নিয়ে বাংলায় সিনেমা তৈরি হচ্ছিল বটে, কিন্তু তাতে বাঙালির দোল উৎসব বা ভারতীয় সংস্কৃতির হোলির গান ঠাঁই পেতে একটু দেরি হল।
১৯৩৭ সাল। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত 'মুক্তি' ছবিটি রিলিজ হল। ছবির নায়িকা কানন দেবী। গবেষকদের মতে, বাংলা সিনেমায় এই প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহার হল। সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক। এই ছবিতে কানন দেবীর লিপে এবং কণ্ঠে 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে' গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ছবিতে সরাসরি দোল উৎসব বা হোলির গান নেই। তবে, এই গানটির ভাবে দোল অর্থাৎ বসন্ত উৎসবের অনুষঙ্গ আছে। কানন দেবী ছবির নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার মুখে গুচ্ছের পাউডার মাখিয়ে গায়ে রঙিন উত্তরীয় জড়িয়ে দিতে দিতে সুরের জাদুতে এই সাদাকালো ছবিতে যেন সেদিন ফাগের রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তারপর ১৯৫৬ সাল। পরিচালক দেবকী কুমার বসুর 'নবজন্ম' ছবি মুক্তি পেল। এই ছবিতে ঘরজামাই উত্তমকুমার গানপাগল এক যাত্রাশিল্পী আর অরুন্ধতী দেবী তাঁর শালাজ অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির তরফে বৌদি। এতে সরাসরি দোল উৎসব বা দোলের গান নেই ঠিকই, তবে অরুন্ধতীকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধিকার রূপ বর্ণনার গান শুনিয়েছেন উত্তমকুমার। আর এই প্রথমবার উত্তমকুমারকে নিজের কণ্ঠে গাইতে শোনা গেল। গান শেষে অরুন্ধতী বলেন, 'উঠি ঠাকুরপো, সামনে দোল আসছে, ঐদিন সকালে তোমার দোলের গান শুনব'। দোলের এই উল্লেখ থাকলেও সেই উৎসব বা গান কোনটাই আমরা দেখতে বা শুনতে পাই না; কারণ ছবির ঘটনা এরপর অন্যদিকে মোড় নেয়।
এরপর বাংলা ছবিতে দোল উৎসব ও দোলের পূর্ণাঙ্গ গান প্রথম দেখা গেল ১৯৬৭-তে মুক্তি পাওয়া ছবি তরুণ মজুমদারের ছবি 'বালিকা বধূ'তে। গানটি হল- 'লাগ লাগ লাগ লাগ রঙের ভেল্কি লাগ, পরানে লেগেছে ফাগুয়া'। ছবিটির বাংলা ও হিন্দি দুটি ভার্সান রয়েছে। বাংলা ভার্সানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটি গেয়েছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিল কোরাস। আমাদের দুর্ভাগ্য হিন্দি ভার্সানটি পাওয়া গেলেও, বাংলা ভার্সানটি আর পাওয়া যায় না। ছবির সমস্ত প্রিন্ট ও নেগেটিভ নষ্ট হয়ে গেছে।
অভিনেতা ও পরিচালক বিকাশ রায় পরিচালিত ১৯৬৯-এ মুক্তি পাওয়া 'বসন্ত বাহার' ছবিতে ঘরোয়া আসরে একটি কালোয়াতি হোলির গান আছে- 'বাঁধো ঝুলনা'। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের লিপে এ গান গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সুর দিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।
১৯৭০-এ অগ্রদূতের পরিচালনায় মুক্তি পেল 'মঞ্জরী অপেরা'। সাদাকালো ছবি। এতে দেখা যায় ঠাকুর ঘরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে বসে একা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হোলির গান গাইছেন- 'আজ হোলি খেলবো শ্যাম তোমার সনে'। গানটি লিখেছিলেন এ ছবির কাহিনীকার ও সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। সুর দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পেল পরিচালক দীনেন গুপ্তর রোমান্টিক-কমেডি, 'বসন্ত বিলাপ'। সাদাকালো এই ছবিতে দোল উৎসব গানে-প্রেমে এবং কমেডি সিচুয়েশনে জমজমাট। বাচ্চা ছেলের পিচকিরি দিয়ে এই সিকোয়েন্স শুরু হয়। রঙ মাখানো, রঙ বেলুন ছোঁড়া, মেয়েদের হস্টেলে ঢুকে চিন্ময়ের জামাকাপড় ছিঁড়ে মার খেয়ে একশা অবস্থা--কি নেই তাতে! আর গানটি হল-'ও শ্যাম যখন তখন, খেলো না খেলা এমন'। অত্যন্ত নাটকীয় এবং ইঙ্গিতবহ এই গানটি লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সুর দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানে লিপ দিয়েছিলেন অপর্ণা সেন ও অন্যান্যরা।
১৯৭৮ সালের সাদাকালো ছবি 'তিলোত্তমা'। দীনেন গুপ্ত পরিচালিত এ-ছবিতে আবির আছে, রঙ মাখানো আছে আর সঙ্গে আছে হোলির গান- 'রঙ শুধু দিয়েই গেলে আড়াল থেকে অগোচরে'। মান্না দে ও অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর এ-গানে লিপ দিয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক ও কল্যাণী মণ্ডল। আর আড়ালে গোপন প্রেম নিয়ে উপস্থিত আছেন সুমিত্রা মুখার্জি। গানটি লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সুর দিয়েছিলেন- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৭৮-এ আরও একটি ছবিতে নাচেগানে জাঁকজমক হোলি খেলা একেবারে হিন্দি ছবির ঘরানায় পিকচারাইজড হয়েছিল। রঙিন ছবি। সম্ভবত এটাই প্রথম রঙিন বাংলা ছবি, যাতে হোলি খেলা দেখা গেল। আলো সরকার পরিচালিত এই ছবির নাম, 'বন্দী'। বাংলা ও হিন্দি ডবল ভার্সান এই ছবিতে সুর দিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, গান লিখেছিলেন-ইনদিবর। আশা ভোঁসলে ও কিশোর কুমারের গাওয়া- 'মনে রঙ না লাগলে তবে, এ হোলি কেমন হোলি' গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন সুলক্ষনা পণ্ডিত ও উত্তম কুমার। গানটিতে ভিলেন অমরীশ পুরীর সঙ্গে আসন্ন সংঘাতের একটি ইঙ্গিত ও টেনশন আছে। গানের শেষে সেই সংঘাত ঘটেও যায়। এদিক থেকে গানটি সিনেমায় একটি নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
১৯৮০-তে মুক্তি পেল তরুণ মজুমদারের মাইলস্টোন ছবি 'দাদার কীর্তি'। ভাগলপুরের পটভূমিকায় এ ছবিতে পথে আবির উড়িয়ে প্রভাতফেরিতে হোলি খেলতে দেখা যায় একদল পুরুষকে, সঙ্গে গান- 'হোলি আয়ি রে'। গানটি সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখার্জি। কণ্ঠ দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখার্জি, শক্তি ঠাকুর ও অন্যান্যরা। আর গানটি লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও হৃদয়েশ পাণ্ডে। এই ছবিতে হোলি খেলার পারিবারিক পটভূমিটিও সুন্দরভাবে দেখা যায়। প্রবাসী স্বামীর জন্য সন্ধ্যা রায়ের অপেক্ষা, স্বামীকে আবির দিয়ে প্রণাম করা, গুরুজনদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করা-- এসব বাঙালি আচার ও মুহূর্তগুলো সুন্দরভাবে উঠে এসেছে এই ছবিতে।
পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর 'রাজবধূ' ছবিতেও হোলি খেলা ও একটি হোলির গান আছে- 'আজো রঙ্গ খেলত মেরে রঙ্গলাল'। ১৯৮২-তে মুক্তি পাওয়া এই গানটি লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সুর দিয়েছেন অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়। আর গানটি গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ পর্যন্ত যত ছবিতে হোলির গান ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে এই গানটি বিশিষ্ট। কারণ, এটি কারও লিপে নেই, আবহে শোনা যায়। ভিজুয়ালে দেখা যায় বাড়ির উঠোনে মুনমুন সেনের হোলি খেলার ফ্ল্যাশব্যাক। শমিত ভঞ্জ বাবা উৎপল দত্তের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করেন, উৎপল দত্ত আশীর্বাদ দেন, শমিতের কাছে আবির নিয়ে মুনমুন উৎপলকে প্রণাম করেন, আশীর্বাদ নেন। এবং সবশেষে আড়ালে শমিত মুনমুনকে আবির মাখিয়ে তাঁর অন্তরে জমিয়ে রাখা প্রেমের প্রকাশ ঘটান। দুঃখের বিষয়, হোলি বা দোল উৎসবের এই বাঙালিয়ানা পরবর্তীকালের ছবিতে খুব একটা আর দেখা যায় না।