মুঘল বাদশার হোলি

সম্রাট আকবর কাজেকর্মে জীবনে হিন্দুমুসলমানের ভেদ রাখেননি। তাঁর দরবারে হিন্দু সেনানায়ক ও সভাসদ এবং অন্দরমহল ও হারেমে হিন্দু নারীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। সেই সময়ের আঁকা ছবিতেই দেখা যায়, তাঁদের নিয়ে হোলি খেলায় মেতেছেন স্বয়ং সম্রাট। সঙ্গে রয়েছেন আমীর ওমরাহরা। দাসদাসী নফরচাকরেরা তো রয়েছে। প্রতিবছর ফাল্গুনী পূর্ণিমার এই উৎসবে গান হত, নাচ হত, গুলাল ও পিচকারিতে রঙ খেলা হত।  রঙ্গরসের আসর বসত। বসত বিরাট ‘মীনা বাজার’। 

এদিন ছোট-বড়র কোন ভেদাভেদ থাকত না। পদমর্যাদায় ছোটরা শুধু রঙ মাখাবার আগে বড়দের বলতেন, ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়...’; ব্যস, তাতেই সাতখুন মাফ হয়ে যেত। রঙ খেলার পর সকলে স্নান করতেন শাহী সরোবরে। সেই সরোবরের জল তাঁদের গায়ের রঙ ধুয়ে হয়ে উঠত শিমূল ফুলের মতো লালে লাল। হোলির পোশাক ছেড়ে সকলেই পরতেন নতুন পোশাক। তারপর থাকত বিশাল ভোজের আয়োজন। এই ভোজের সময়ই একবার ঘটেছিল এক অদ্ভুত ঘটনা।

 সেবার চেরামতি নামের একটি জায়গায় হোলির উৎসব শেষে বেশ ভুরিভোজ চলছে, এমন সময় পাশেই একটা জায়গার মাটি ফুঁড়ে আগুন আর ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো। অমনি বিষম ভয় পেয়ে খাওয়া ছেড়ে সব্বার সে কি ছোটাছুটি! সবাই ভাবল বুঝি এ শয়তানের কাণ্ড! তারপর যখন বুঝল আলেয়ার আগুন, তখন জব্বর আমোদ হল। এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার কথা আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’-বইটিতে লেখা আছে।

ঈদ’ আর ‘হোলি’  একইসঙ্গে সম্রাট আকবরের কাছে সমান আদরের, সমান আনন্দের উৎসব ছিল। মর্যাদা দিতেন তাঁর অন্তঃপুরের রাজপুত রানীদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের। তাঁদের জন্য ইষ্টদেবতার মন্দির গড়ে দিয়েছিলেন। সেই দেবতার পূজা-উৎসবে আকবর সানন্দে অংশ নিতেন।

আকবরপুত্র জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন যে, সেকালে হোলি উৎসব ছিল আসলে নতুন বছরের উৎসব। রঙ খেলার পর পুরনো পোশাক ছেড়ে নতুন পোশাক পরার মধ্যে লুকিয়ে ছিল পুরনো বছরের সমস্ত গ্লানি ত্যাগ করে নতুন বছরের নতুন জীবনে প্রবেশের প্রতীক। হোলির আগের দিন  চাঁচরে 'মেড়া পোড়া' নামক যে আচার পালিত হয়, সেকালে তার মধ্যে ছিল হিন্দুদের মৃতদেহ দাহের সংস্কার। মানুষ মারা গেলে তাকে যেমন দাহ করা হয়, তেমনই মৃত অর্থাৎ বিগত বৎসরকেও যেন প্রতীকীভাবে দাহ করা হত কাঠের আগুনে এই বহ্নুৎসবের মধ্য দিয়ে।

 সেকালে সম্রাট আকবরের দরবার ছাড়াও অযোধ্যার নবাব আসফ-উদ-দৌলার দরবার ও রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবে হোলির উৎসবে মেতে উঠতেন। নবাব সুজা-উদ-দৌলারও বড় প্রিয় ছিল এই হোলি উৎসব। মোঘল দরবারে এই ঐতিহ্য আকবর থেকে শুরু করে চলেছিল সাজাহানের কাল পর্যন্ত। আওরঙ্গজেব সেই প্রথা বন্ধ করে দেন। তারপর আবার চালু হয়েছিল দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলে। তবে সম্রাট আকবরের সেই সম্প্রীতির ঐতিহ্যে হোলি উৎসব আজও সমগ্র ভারতে বিবিধের মাঝে মিলনের উৎসব, একই রঙে হৃদয় রাঙানোর উৎসব, হিন্দুমুসলমানের সম্প্রীতির উৎসব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...