উত্তরভারতে যা ‘হোলি,’ আমাদের উৎকল-বঙ্গে তাকেই বলি, ‘দোল’। সর্বত্রই আবির, ফাগ আর পিচকারিতে চলে আমাদের চির-পরিচিত রঙের খেলা।
খেলাটি পরিচিত, তবে আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, অতিপ্রাচীনকালে ভক্তির চেয়ে কৃষিজীবনের সঙ্গেই হোলি উৎসবের ভাব ছিল বেশি। পাঞ্জাবের হোলিতে এখনও সেই কৃষিযোগের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে এই উৎসব হয় কৃষি-দেবতার পুজোকে কেন্দ্র করে। উৎসবের নাম, ‘হোলা মোহাল্লা’। এতে দু’দিন ধরে নাচ, গান, ঘোড়ায় চড়া, আবির ও পিচকারিতে রঙ খেলা হয়। তারপর স্নান সেরে চলে মালপোয়া, লাড্ডু, গুজিয়ার ভুরিভোজ।
শুধু ভোজ নয়, মহারাষ্ট্রের হোলিতে আবার বিশেষ গল্পও আছে। সেই গল্পের মধ্যে স্পষ্ট যে, হোলি একসময় আসলে ছিল নতুন বছর উদযাপনের উৎসব।
আসলে, তখন বছর শুরু হত ফাল্গুন মাস থেকে। সেকালে এদিন এখানকার মানুষ অবশ্যই নতুন পোশাক পরতেন। আর ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই স্পর্শ করতেন তথাকথিত এমন কোন অন্ত্যজশ্রেণির মানুষকে, যাকে কিনা সারা বছর ছোঁয়াছুঁয়ি হলে জাত যাবার ভয়ে এড়িয়ে চলতেন। কেন স্পর্শ করতেন?
আসলে, সেকালে লোকের বিশ্বাস ছিল যে, ওই অচ্ছুৎ মানুষটিকে ছোঁয়ার ফলে বছরের প্রথম দিনই তিনিও মৃত্যুর দেবতা যমের কাছেও অচ্ছুৎ হয়ে গেলেন। এবার তাঁকে কাছে টেনে নিতে যমেরও অরুচি হবে। ফলে, সারাবছর আর তাঁর বা তাঁদের মৃত্যুভয় থাকবে না। আজকের দৃষ্টিতে বিষয়টা বর্ণাশ্রমের ঘৃণ্য মানসিকতাকে স্মরণ করায়, মানবতা ও মানবাধিকারকে অপমান করে।
বিহার তথা উত্তরাঞ্চলে 'হোলি'-সংক্রান্ত যে গল্পটি প্রচলিত আছে, সেই গল্পের মূলে এক রাক্ষসী। সেই রাক্ষসী একদা বরলাভ করেছিল যে, হোলির দিন যদি কোন মানুষ সভ্যভব্য হয়ে থাকে, তাকে সে টুক করে খেয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু, মানুষের কল্যাণের জন্য শিব দিলেন তাতে বাগড়া। তিনি কী করলেন?
তিনি এমন মায়াজাল সৃষ্টি করলেন যে, হোলির ক’টা দিন মানুষকে সভ্যভব্য হয়ে থাকতেই দিলেন না। তারই প্রভাবে মানুষ একেবারে উন্মত্তের মতো আচরণ শুরু করল। তাই রাক্ষসী এদিন আর মানুষ ধরে খেতে পারল না।
সেই মিথটি মাথায় রেখেই, এ-সব অঞ্চলে ভাঙ খেয়ে উন্মত্ত হয়ে আজও হোলি খেলেন মানুষেরা। গ্রামদেশে এখনও সেই সঙ্গে অভব্যতার নজির তুলে ধরতে খেউড়, গালাগালির রঙ্গরস আর আদিরসের গান গেয়ে মাতিয়ে তোলা হয় হোলির আসর।
উত্তর প্রদেশের 'লাঠমার হোলি'তে বারসানায় যে অভিনব নারীশাসিত হোলি খেলা হয়, তার পেছনেও আছে এক গল্প।
হোলির আগে একবার নন্দগ্রাম থেকে কৃষ্ণ তাঁর গোপসখাদের নিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন পাশেই রাধার গ্রাম বারসানায় হোলির প্রস্তুতি কেমন চলছে। তখন সেখানে রাধার সখীদের গোপসখারা খুব উত্যক্ত করেছিল। এতেই ক্ষেপে গিয়ে সখীরা লাঠি হাতে প্রতিবাদ করে সখাদের বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দিয়েছিল।
এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করেই এখনও এই অঞ্চলে মূল হোলি খেলার আগে বারসানার মেয়েরা রাধার সখী সেজে মজার ছলে নন্দগ্রামের পুরুষদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থাকেন। এই সময় নন্দগ্রামের পুরুষেরা এ-গাঁয়ে আসেন গোপসখা সেজে, আর হাতে নিয়ে আসেন আত্মরক্ষার জন্য ঢাল।
তামিলনাড়ুর 'হোলি' উৎসব প্রাচীন মদন উৎসবের স্মৃতি এখনও বহন করে চলেছে। সেখানে এদিন একটি সুন্দর কাঠের ঘর বানিয়ে তার মধ্যে কামদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর তাঁর কোলে বসিয়ে দেওয়া হয় রতিদেবীকে। তারপর নাচগানে-পার্বণে তাঁদের পুজো করা হয়। হোলির দিনে এই যে মদন পুজো বা মদন-উৎসব, এর মূলেও আছে গল্প। বলছি।
পৌরাণিক গল্পে, তারকাসুর বর পেয়েছিল যে, একমাত্র শিবের পুত্রই তাকে হত্যা করতে পারবে। কিন্তু, তার অত্যাচারে ত্রিলোক যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, তখনও তাকে হত্যার জন্য শিবের পুত্র জন্মাল না। জন্মাবে কী করে, শিবের যে বিয়েই হয়নি, তার ওপর নিষ্কাম হয়ে তিনি সারাক্ষণ ধ্যানে মগ্ন!
উপায় না-দেখে দেবতাদের অনুরোধে মদনদেব শিবের মনে কাম জাগিয়ে ধ্যান ভাঙাতে বসন্ত ঋতুর সৃষ্টি করে কামশর নিক্ষেপ করলেন শিবের প্রতি। তাতে চমক লেগে অসময়ে ধ্যান ভাঙায় শিব খুব রেগে গেলেন। অমনি তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে আগুন বেরিয়ে এল, আর তাতেই মদন ভস্ম হয়ে গেলেন।
এদিকে কামবাণও তখন ক্রিয়া করতে শুরু করে দিয়েছে। ফলে, শিবের বিয়ের ইচ্ছে হল। দেবতারা শিব-পার্বতীর বিয়ে দিলেন। তাঁদের মিলন হল। পুত্রের জন্ম হল। সেই পুত্র তারকাসুরকে বধ করল। ত্রিলোক রক্ষা পেল।
এখন এই যে নিজের জীবন দিয়েও মদনদেব ত্রিলোকের মঙ্গল করলেন এবং 'বসন্ত' নামক ফুলে ফুলে রঙিন একটি নতুন ঋতুর জন্ম দিলেন, তাঁর সেই অবদানের কথা স্মরণ করেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সূচনা হয়েছিল, 'বসন্ত উৎসব' তথা 'মদন উৎসব'-এর। তাছাড়া এই মদন উৎসব মেয়েদের বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং মনের মতো স্বামী পেতে মদন তাঁদের বিশেষ পূজ্য হয়ে উঠেছিলেন, কেননা শিব ও পার্বতীর বিয়ে সম্ভব হয়েছিল, পার্বতী মনের মতো স্বামী পেয়েছিলেন মদনদেবের আত্মদানের বিনিময়েই।
এভাবেই সারা দেশের হোলি উৎসবের বৈচিত্র্যময়তার দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আজকের হোলি বা দোল উৎসবের প্রকৃত ইতিহাস। বেদের যুগের সূর্য পূজার সঙ্গে ছিল কৃষিজীবনের ঘনিষ্ঠ যোগ। বলা যায়, একই অঙ্গে সূর্য পূজা, মদন উৎসব, বসন্তোৎসব, নববর্ষ উৎসব, রাধাকৃষ্ণের দোলা—সব আত্তীকরণ করে গড়ে উঠেছে আজকের এই দোল উৎসবের বর্ণময় ঐতিহ্য।