এক সময় ‘গরিবের শীতলপাটি’ বলে হত হোগলা কে। ঘরে ঘরে দেখা যেত হোগলা পাতার চাটাই। উৎসব থেকে পূজা-পার্বন সব ধরনের অনুষ্ঠানে বসার জন্য হোগলা চাটাই ব্যবহৃত হতো।
গ্রাম বাংলার প্রাচীন শিল্প হোগলা। হোগলা ঝোপের মতো দেখতে ছোট আকারের গুল্ম গোত্রের এক সদস্য এবং সুন্দরবনের নদী-নালার কিনার বরাবর প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। হোগলা দেখতে অন্যান্য সাধারণ ঘাসের মতোই, এর উচ্চতা হয় দুই থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত। পত্রফলক চ্যাপ্টা এবং স্পঞ্জের মতো নরম কলায় গঠিত। এই উদ্ভিদ থেকে প্রচুর পরিমাণ পরাগরেণু উৎপন্ন হয়। এর মূলতন্ত্র আঁশ বা তন্তুর মতো অংশে গঠিত।
হোগলার মরশুম মূলত বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাসে হোগলা কাটা হয়। সারা বছরই হোগলার তৈরি জিনিসের চাহিদা ও বাজার থাকে।
হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া অঞ্চলের একটি অন্যতম শিল্প হল হোগলা শিল্প। হোগলার পাতা দিয়ে মাদুর, ছই, প্রভৃতি তৈরি করেন হোগলা শিল্পীরা।
হোগলা শিল্পকে কেন্দ্র করে বহু পরিবার পরিবার বেঁচে আছে। কেউ হোগলা শিল্পের কারিগর হিসেবে কাজ করে, কেউ হোগলা থেকে তৈরি জিনিস বিক্রি করে রুজি রোজগার করে।
উলুবেড়িয়ার নোনা,করাতবেড়িয়া ও নিমদিঘি সংলগ্ন এলাকার প্রচুর মানুষের রুটি-রুজির অন্যতম সংস্থান হোগলা শিল্প।
হাওড়া জেলার মধ্যে শুধু উলুবেড়িয়ার নিমদিঘিই নয়, আশেপাশের অঞ্চলের মানুষও আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে এই শিল্পের হাত ধরে। কুলগাছিয়া, হাটগাছা, পালিতাবাউড়ী, বীরশিবপুর, নলপুর, আবাদা ও সাঁকরাইল অঞ্চলে হোগলার তৈরি চাটাই, মাদুর ও অন্যান্য জিনিসের ভাল বাজার তৈরি হচ্ছে।
হুগলী নদীর পলি সমৃদ্ধ এলাকা, নিচু জমি, হোগলা ফলনের জন্য আদর্শ। উলুবেড়িয়ার উর্বর মৃত্তিকা, হুগলী ও দামোদরের সেচের অফুরন্ত জল। এই অঞ্চল মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা।
এই সকল অঞ্চলের রেল লাইন এবং বোম্বাই রোডের পাশের ঝিলগুলিতে বিনা খরচায় ও বিনা পরিশ্রমে হোগলা জন্মায়। এছাড়া বীরশিবপুর গ্রামের হাটগাছা,ললিতাগোড়ি এবং বাহাদুরপুর অঞ্চলে নিচু জমিতে হোগলার চাষ করে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একটি মরশুমের জন্য হোগলা বনের সত্ত্ব নিয়ে নেন।
হোগলা গাছ কাটার পর চলে ঝাড়াই বাছাই পর্ব। এর পর চলে আসে বিভিন্ন কারিগরদের কাছে। কারিগররা বিভিন্ন সাইজের ছই তৈরি করে। হোগলা পাতার তৈরি ছাউনীর নাম ছই। এই ছই পাইকাররা কিনে বিভিন্ন অঞ্চলে চালান দেয়।
উলুবেড়িয়া অঞ্চলের কারিগরদের তৈরি হোগলা ছই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তো বটেই, অন্যান্য রাজ্যেও ভাল চাহিদা আছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশেও চালান হয়ে থাকে নিয়মিত।
হোগলা শিল্পের কারীগররা মহাজনদের থেকে বরাত পায়। কাঁচামাল হিসাবে তারাই হোগলা পাতা দিয়ে যায়। সেই দিয়েই হোগলা দিয়ে ছই এবং বসার মাদুর তৈরি করে বাজারে দেওয়া হয়। একজন দক্ষ কারিগর সারাদিনে ৮/৯ খানার বেশি ৭ ফুট বাই ৫ ফুটের ছই তৈরি করতে পারে না। হোগলা শিল্প মূলত কুটির শিল্প। বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারেন কারিগর ও শিল্পীরা। অনেক পরিবার এমন আছে যাদের প্রতিটি সদস্য কোনও না কোন ভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মহিলা, পুরুষ,শিশু সকলেই হোগলা বুনে থাকে।
হোগলা ছই মহাজনেরা পাইকারদের কাছে শতকরা ২৫০০/৩৫০০ টাকা করে বিক্রি করে। একটা ছই তৈরি করতে যে পরিমাণ মেহনত করতে হয়, সেই অনুপাতে হোগলা শিল্পের কারিগররা পারিশ্রমিক পায় না।
অভাবের চাপে পড়ে তারা কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হয়। আর একটা কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কারিগরের সংখ্যা বেশি।
ধনী ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে হোগলার জমি কিনে নেয়। আবার কেউ চাষীদের কাছ থেকে ৭০ টাকা বাণ্ডিল হিসাবে হোগলা কেনে কিন্তু চাহিদার সময় ১৫০ টাকা বাণ্ডিল হয়ে দাঁড়ায়। মূলত মূলধনের অভাবে এই সব গরিব হোগলা শিল্পের কারিগররা হোগলা বন এবং কম দামে বাণ্ডিল কিনতে পারে না।
হাওড়া জেলার নিমদিঘি হোগলা শিল্পের জন্য সবচেয়ে পরিচিত নাম। এই অঞ্চলের প্রায় দু’শোর কাছাকাছি পরিবার সরাসরি হোগলা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
এক-দেড় ফুট ফাঁকে ফাঁকে লাইন করে হোগলা গাছ রোপণ করা হয়। ১৫-২০ দিন পর গোড়ায় চারা গজাতে শুরু করে। এই চারা ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা হলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে পাতা মোটা ও ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়।
হাওরা জেলার উলুবেড়িয়া মূলত কৃষি ভিত্তিক অঞ্চল। বড় শিল্প সেভাবে কিছু গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আছে হোগলার মত কৃষিনির্ভর কুটির শিল্প। তার হাত ধরেই আয়ের নিশ্চয়তা খুঁজছে সেখানকার মানুষ। শহরকেন্দ্রিক কর্ম সংস্থানের বদলে নিজস্ব স্বাধীন পথ। এঁরা হাজার এক অসুবিধা, ঋণ সমস্যা, মহাজনী চাপ থাকা সত্ত্বেও চাইছেন এই পেশাতে থিতু হতে।