শিব ঠাকুরের আপন দেশ কৈলাসে বাস করেন এক ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী। ব্রাহ্মণের নাম, ধর্মদেব। ব্রাহ্মণীর নাম, বৃন্দা। ব্রাহ্মণী যেমন সুন্দরী, তেমনি তাঁর ধর্মেকর্মেও খুব মন। স্বামীস্ত্রীতে তাঁরা বিষ্ণু ভগবানের ভক্ত। ইষ্ট বিষ্ণুর মতো তাঁদেরও কোন ছেলেপুলে নেই। হাপিত্যেশও নেই। ইষ্টপদে মনটি রেখে তাঁরা বেশ সুখেশান্তিতেই আছেন। তার ওপর অপূর্ব সুন্দর গান গাইতে পারেন ধর্মদেব। গেরস্তের ঘরে ঘরে, সাধুঋষিদের দ্বারে দ্বারে, দেবতাদের লোকে লোকে বিষ্ণুগুণগানে সকলকে মজিয়ে নিজে বিভোর হওয়াই তাঁর কাজ। আর এই কাজে চাট্টি ভিক্ষেশিক্ষেও জুটে যায়, তাতেই দিন কাটে দেদার।
সুখ বেশিদিন কোথাও থাকে না। তাই তাঁদের সুখী দাম্পত্যেও একদিন ঘটে গেল একটা দুর্ঘটনা। সেদিন বিষ্ণুনামে বিভোর হয়ে ধর্মদেব গেরস্তের দোর পেরিয়ে, কৈলাস ছাড়িয়ে চলে গেলেন অনেক অনেক দূরে; বাড়ি ফেরার কথা তাঁর আর খেয়ালই রইল না। বৃন্দা এদিকে কখন রেঁধে-বেড়ে দু'চারজন অনাহুত অতিথিকে অন্নসেবা করিয়ে বিদায়ও দিয়ে ফেললেন, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ছুটে চলল; তবু, ধর্মদেব ফিরলেন না। ফেরার আশায় বসে থাকতে থাকতে খিদেয় বৃন্দার পেট জ্বলে যেতে লাগল। কিন্তু, উপায় তো নেই, স্বামী ফিরে না-খাওয়া অব্দি স্ত্রী হয়ে তিনি খাবেন কেমন করে!
অপেক্ষায় অস্থিরতা বাড়ে। তখন দম ধরে আর রাখা যায় না। গ্রহের ফেরে আজ এমন হয়েছে যে, কিছুতেই খিদে সহ্য করতে পারছেন না বৃন্দা। দূর ছাই! অধীর হয়ে উঠোন পেরিয়ে সামনের রাস্তায় খানিক পর পর বার কয়েক উঁকিও দিলেন, কিন্তু নাহ্, ধর্মদেবের দেখা নেই। মানুষটা বিষ্ণুনামে বিভোর হলে সব ভুলে যান। কালেভদ্রে তাঁর বাড়ি ফিরতে বিকেল তো হয়ই, সন্ধ্যেও পেরিয়ে যায় কখনো কভু। তাই বৃন্দার আজকাল অন্য দুশ্চিন্তা হয় না। স্বামী কখন ফিরবেন ঠিক যখন নেই, তখন বৃন্দা ভাবলেন যে, একা একা বসে আর কতক্ষণ খিদের সঙ্গে লড়বেন, তার চেয়ে এর বাড়ি-ওর বাড়ি গিয়ে চাট্টি গল্প করলে সময় তো কাটবেই, সেই সঙ্গে খিদের কথাও ভুলে থাকা যাবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পাড়া বেড়িয়ে গেলেন গল্পগাছা করতে।
ওদিকে খানিক পরেই বাড়ি ফিরলেন ধর্মদেব। কিন্তু, উঠোনে পা দিয়েই অবাক হলেন। কই, নিত্যদিনের মতো উঠোনের কোনে তাঁর হাতমুখ ধোবার জল তো তোলা নেই; কই, হাতে পাখা আর তৃষ্ণার জল নিয়ে বৃন্দা তো এগিয়ে এলেন না! তিনি বৃন্দার নাম ধরে কত বার ডাকলেন। কই, কেউ তো সাড়া দিল না। বৃন্দার নাম ধরে সজোরে হাঁক পাড়লেন। কই, কেউ তো ছুটে এল না! তবে! অজানা আশঙ্কায় ধর্মদেব অস্থির হয়ে উঠলেন। অস্থির হয়ে খানিক পায়চারি করে কর্তব্যকর্ম স্থির করে বৃন্দার সন্ধানে তিনি যেই বেরুতে যাবেন, অমনি বৃন্দা প্রায় ছুটে ঢুকলেন সদর দরজা দিয়ে। দু'জনে মুখোমুখি হয়ে থমকে গেলেন। ধর্মদেবের পাথরের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর ধ্বক করে কেঁপে উঠল বৃন্দার। সহসা কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। প্রথম কথা বললেন ধর্মদেব। বৃন্দার মুখের দিকে অপলক চেয়ে কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন, 'কোথায় গিয়েছিলে?' অপরাধবোধ তখন বৃন্দাকে ঘিরে ধরেছে। ধর্মদেবের মুখের ওপর থেকে চোখ আগেই নামিয়ে নিয়েছিলেন। এবার মৃদু স্বরে জানালেন যে, অনেক অপেক্ষার পর খিদে চাপতে পাড়া ঘুরে গল্পগাছা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু, এর বেশি কথা বৃন্দাকে ধর্মদেব বলতেই দিলেন না। এটুকু শুনেই তিনি রাগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। সেই রাগে তাঁর আর হুঁশ রইল না। বজ্রকণ্ঠে বৃন্দাকে দিয়ে বসলেন অমোঘ এক অভিশাপ, 'রে পাপিষ্ঠা নারী, তুই নির্লজ্জের মতো পেটে খিদে নিয়ে পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছিস! গালগল্পে মত্ত হয়ে স্বামীর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেছিস! যা এই মুহূর্তে নীচ রাক্ষসযোনিতে জন্ম নিয়ে পেটের খিদেয় ঘুরে বেড়াবি যা!'
হঠাৎ রাগে এ কী করলেন ধর্মদেব! তাঁর অভিশাপ তো মিথ্যে হবার নয়। এ যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড! সত্যি বলতে কী, পাপের বিচারই তো ঠিক করে হল না। তাই, স্বামী অনুরক্তা হয়েও বৃন্দা মুক্তির উপায় চেয়ে স্বামীর পায়ে পড়লেন না। তাঁর কথা ভালো করে না-শুনেই স্বামী অভিশাপ দিয়ে বসলেন! ভালোবাসার চেয়েও নিত্যকর্তব্যই বড় হল তাঁর কাছে! ভারি অভিমান হল বৃন্দার। মুখ তুলে আর ধর্মদেবের দিকে ফিরেও চাইলেন না। কথা বললেন না। শুধু ইষ্টদেব বিষ্ণুর চরণ স্মরণ করে নীরবে তনু ত্যাগ করলেন। জন্ম নিলেন কৈলাস পাদদেশে অবস্থিত অরণ্যের এক রাক্ষসীর গর্ভে।
তারপর কেটে গেল কত না বছর-কাল। বৃন্দা রাক্ষসী হয়ে এখন আজন্ম খিদের জ্বালায় অরণ্য দাপিয়ে ঘোরেন আর পশুপাখি যা পান তাই খান। তবে রাক্ষসীরূপে জন্ম নিয়েও তিনি পূর্বজন্মের একটি সাধুপথ কিন্তু ভোলেননি, তা হল, বিষ্ণুভক্তি। তাই শত খিদের জ্বালাতেও ব্রাহ্মণ এবং গাভী-ভগবতীর কোন ক্ষতি তিনি করেন না। এদিকে তাঁর খিদের চোটে কিছুদিনের মধ্যেই অরণ্যের সমস্ত পশুপাখি নিঃশেষ হয়ে গেল। খাবারের সন্ধানে তখন কৈলাসের জনপদে হাজির হলেন বৃন্দা। কিন্তু, এখানে এসেও আহারের কোন উপায় হল না। কারণ, কৈলাসে সকলেই ব্রাহ্মণ, অনেকেই বিষ্ণুভক্ত। সকলের গৃহেই রয়েছে বৎসাতুর গাভী। কাজেই, খিদের জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে অনাহারে দিন কাটতে লাগল বৃন্দার। তিনি গিয়ে আশ্রয় নিলেন শিবের নন্দন বনের সরোবরটির পাড়ে।
বৃন্দার এই দুরবস্থা দেখে কৈলাসের বিষ্ণুভক্তদের বড় দয়া হল। বৃন্দার সমস্ত বৃত্তান্তই তাঁদের জানা। তাই সবাই মিলে খুঁজতে শুরু করলেন তাঁর রাক্ষসীজন্ম থেকে মুক্তিলাভের উপায়। কেউ বললেন, তপস্যায় মুক্তি হবে। কেউ বললেন, তিতিক্ষায়। কেউ বললেন, কৈলাসধামেই মুক্তি হবে। কেউ বললেন, হরিনামে। শেষের উপায়টিই সমস্ত বিষ্ণুভক্তের কাছেই একমাত্র মোক্ষপথ বলে মনে হল। সুতরাং, তাঁরা অহরাত্র হরিনাম গান গেয়ে শোনাতে শুরু করলেন বৃন্দাকে। সেই নামগান শুনতে শুনতে সাত দিনের দিন অনাহারে-উপবাসে বৃন্দার রাক্ষসী জন্ম শেষ হল।
কেটে গেল পুরো একটা বছর। তবুও হরির নামমাহাত্ম্যে রাক্ষসী বৃন্দার নিষ্প্রাণ শরীর কিন্তু নষ্ট হল না।
সেই নন্দন বনে একদিন পার্বতী ও গণেদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দ বিহার করতে এলেন স্বয়ং শিব। সরোবরের সন্নিকটে ভ্রমণ করতে করতে হঠাৎ পার্বতীর চোখ গেল বৃন্দার মৃতদেহটির দিকে। অবাক হয়ে তিনি দেখলেন, উজ্জ্বল এক স্বর্গীয় আলোয় ঘিরে রয়েছে সেই দেহ। দেহজুড়ে জ্বল জ্বল করছে বিষ্ণুর দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্র--'ওঁ নমো ভাগবতে বাসুদেবায়'! এমন অদ্ভুত দৃশ্যটি একা দেখে এর রহস্য মোচন করতে পারলেন না পার্বতী। প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে দেখালেন শিবকেও। শিবের সঙ্গে গণেরাও ছুটে এল। অবাক উৎসুক্যে মন্ত্র স্পর্শ করতে গিয়ে তারা ছুঁয়ে ফেলল বৃন্দার দেহ। অমনি সেই দেহ কোটি কোটি খন্ডে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এবং কী আশ্চর্য, প্রতিটি খন্ডের ওপরেও জ্বল জ্বল করতে লাগল দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্র! পার্বতী আরও অবাক হলেন। শিবের কাছে জানতে চাইলেন এই অদ্ভুত ঘটনার রহস্য।
প্রশ্ন শুনে শিব স্মিত হাসলেন। বললেন, 'হরিনাম-বিষ্ণুনাম ভক্তিভরে শুনলে এ-রকমই যে হয়, প্রিয়ে; নশ্বর শরীরও অবিনশ্বর হয়ে ওঠে! মহাপাপিষ্ঠ বলে সমাজ যাকে দূর দূর করে, সেও মোক্ষের সন্ধান পায়। আর বৃন্দা? সে তো বিষ্ণুর পরমভক্ত। দৈব অবশে স্বামীর প্রতি কর্তব্যে যে সামান্য অবহেলা সে করে ফেলেছিল, তার জন্য জীবন দিয়ে জন্ম দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে আজ সে শুধু শুদ্ধই নয়, বিষ্ণুপ্রিয়াও বটে। তাই ইষ্টের ইচ্ছেয় তার চিরস্থায়ী ঠাঁই হবে বিষ্ণুর অর্ঘ্যে। ধরার বুকে বৃন্দার দেহের কোটি কোটি অংশ অচিরেই পবিত্র গুল্মরূপে জন্ম নেবে। সেই গুল্মের নাম হবে, 'তুলসী'। 'তু'-অক্ষরে মৃত্যুর কথা বলেও, 'লসী'-অক্ষরদ্বয়ে নাচতে নাচতে বেঁচে ওঠার কথা বলবে এই গুল্ম। তাই একদিন পবিত্রতম গুল্ম হিসেবে তুলসী সমস্ত মানুষের কাছে হবে পরম পূজ্য; এর অঙ্গেই হবে তোমার-আমার নিরন্তর অধিষ্ঠান। তুলসীর প্রতিটি পাতায় রবে বিষ্ণুর দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্র। তাই তুলসীপত্র বিষ্ণুপূজায় হবে এমন এক অমূল্য অর্ঘ্য, যার অভাবে বিষ্ণু অন্য কোন অর্ঘ্য স্বীকারই করবেন না।' শিবের কথা শেষ হতে-না-হতেই কাঁদতে কাঁদতে সেখানে হাজির হলেন ধর্মদেব। বৃন্দাকে অভিশাপ দেওয়ার পর থেকে তিনিও অনুশোচনার আগুনে নিরন্তর পুড়ছেন। শিবের পায়ে ধরে এবার চোখের জলের পরম আকুতিতে চাইলেন প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ। যদিও সংসার থেকে বৃন্দাকে দূর করে তিনি যে শাস্তি দিয়েছেন, তার প্রায়শ্চিত্ত নেই; তবুও বৃন্দা যদি 'তুলসী' হয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া হন, তাহলে তার মূল হয়ে তিনি বৃন্দার পায়ের নীচে ঠাঁই পেয়ে শান্তি পেতে চান। পায়ে ধরে আজীবন প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করতে চান। ধর্মদেবের সুবিনীত এমন আকুতিতে তুষ্ট হলেন শিব। কৃপা করলেন। বললেন, 'তথাস্তু, তাই হবে।'
অতঃপর শিব তাঁর অনুচর গণসমূহকে আদেশ দিলেন, বৃন্দার শরীরের প্রতিটি খন্ড নিয়ে কৃষ্ণপদধন্য পুণ্যভূমি বৃন্দাবনের যমুনাতীরে হাজির হতে। আদেশমাত্রই কোটি কোটি গণের পদধ্বনিতে পরিপূর্ণ হল বৃন্দাবন। তাদের সঙ্গে শিব এলেন, পার্বতী এলেন। মহাসমারোহে যমুনাতীরে একে একে সমাধিস্থ হল বৃন্দার কোটি কোটি দেহখন্ড।
কালচক্রে সময় অতিবাহিত হল। এল শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস, কার্তিক। এল, অমাবস্যা তিথি। ধরার মাটিতে সেই পুণ্যলগ্নে দেহখন্ড থেকে বৃন্দা জন্ম নিলেন পুণ্যগুল্ম 'তুলসী' রূপে। মেললেন কৃষ্ণশ্যামল পাতা। তারপর কালের প্রবাহে ধীরে ধীরে বৃন্দাবনের মাটি থেকে সেই পুণ্যগুল্ম ছড়িয়ে পড়ল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। ঘর হারানো বৃন্দা, ঠাঁই পেলেন 'তুলসী' হয়ে সবার ঘরে ঘরে।
গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের বিরচিত, 'বৃহদ্ধর্ম পুরাণ'।