কালীর উপস্থিতি থাকলেও, হিন্দু ধর্মে একেবারে প্রথম দিকে কালীর উপাসনা এতো জনপ্রিয় ছিল না। আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কালীর আরাধনা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মা কালীকে মনে করা হয় শক্তির এক রূপ, দশ মহাবিদ্যার এক অংশ। মান্ডুকি উপনিষদে কালীকে অগ্নির এক অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যমতে, মনে করা হয় অথর্ববেদেই সর্বপ্রথম কালীর কথা বর্ণিত হয়েছে।
কলকাতা বহু শতাব্দী প্রাচীন একটি জনপদ, অসংখ্য কালী মন্দির যাদের রয়েছে আনন্দ নগরে। শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরগুলো এ শহরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য মিশে গিয়েছে। কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কালী ক্ষেত্রে। কেউ কেউ বলেন কালী থেকেই কলকাতা নামের জন্ম। আজ কালীকথায় কলকাতার এক কালী ক্ষেত্রের কথাই বলব।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়ার প্রসিদ্ধ শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমায়ের মন্দির বা ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কথা। ঠনঠনিয়ার এই শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরীর মন্দির বা ঠনঠনিয়া কালী বাড়িকলকাতার ঠনঠনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত অতি প্রাচীন এক কালী মন্দির।বিধান সরণির বুকে দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির। জনশ্রুতি অনুসারে, ১৭০৩ সালে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে জনৈক এক তান্ত্রিক মাটি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি গড়েন। ১৮৬০ সালে জনৈক শঙ্কর ঘোষ বর্তমান কালীমন্দির ও পুষ্পেশ্বর শিবের আটচালা মন্দির নির্মাণ করেন। সেই থেকেই নিত্য পুজোর প্রচলন হল। এই শঙ্কর ঘোষ পুজোর যাবতীত ব্যয়ভার গ্রহণ করলেন। এখানে মায়ের মূর্তি মাটির, প্রতি বছর মূর্তি সংস্কার করা হয়। ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণীর পুজো, কার্তিক অমবস্যায় আদিকালীর পুজো ও মাঘ মাসে রটন্তী কালীর পুজো হয়। শঙ্কর ঘোষের পরবর্তী বংশধরেরাই বংশানুক্রমে এখনও এই মন্দিরের সেবায়েত। কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালী পুজোর দিনে মহাসমারোহে পূজিত হন সিদ্ধেশ্বরী।
জঙ্গলে ঘেরা সুতানুটি গ্রাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। আজকের কলকাতা তখন কল্পনারও অতীত। নদীর পাশে বন জঙ্গলে ঘেরা এক শ্মশানের মধ্যে তান্ত্রিক উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী মাটির সিদ্ধেশ্বরী কালীর মূর্তি তৈরি করেন। আনুমানিক ১৭০৩ সাল। ১৮০৩ সালে শঙ্কর ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী মায়ের মন্দির গড়ে দেন। কেউ কেউ বলেন ১৭০৩ সালে গিরিশ ঘোষ এই মন্দিরটি দেবী কালীকার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। অধিষ্ঠাতা ভৈরব পুষ্পেশ্বর শিবের জন্যেও গড়ে ওঠে আটচালা।
যদিও রাধারমণ মিত্র লেখা থেকে জানা যায়, ঠনঠনিয়ার সাবেক কালীমন্দির ১৮০৩ সালে তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান মন্দিরের গায়ে এক পাথরে ১১১০ সাল লেখা রয়েছে। ওই প্রস্তর ফলককে প্রনিধানযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করলে বোঝা যায় ১৮০ সালে নয় কালী মন্দিরটি ১৭০৩ সালেই তৈরি হয়েছিল।
জঙ্গলাকীর্ণ উত্তর কলকাতায় সেই সময় অর্থাৎ ১১১০ বঙ্গাব্দে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে জনৈক যে তন্ত্রসাধক মৃন্ময়ী শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমায়ের নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করলেন, সেই ব্রহ্মচারীর অবর্তমানে একজন হালদার বংশীয় ব্রাহ্মণ দেবীর ভার নেন। এর প্রায় এক শতক পরে ১২১০ বঙ্গাব্দে ঠনঠনিয়ার বাবু শঙ্কর চন্দ্র ঘোষ মহাশয় মায়ের জন্য বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন। প্রসঙ্গত, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদ ও সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামী সুবোধানন্দজী মহারাজ এই শঙ্কর ঘোষের বংশধর ছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই মন্দিরে বহুবার এসেছেন। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কিশোর গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান শুনেছেন। কামারপুকুর থেকে এসে এই মন্দিরের অদূরেই ঝামাপুকুরে থাকতেন গদাধর। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে গদাধর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হওয়ার পরেও, বারবার ঠনঠনিয়া কালীকে দর্শন করতে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরের কালীঘরের ঠাকুর। এই দেবী সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গলাতেও গান শুনেছেন। তিনিও সিদ্ধেশ্বরী কালীমাকে দর্শন করতে আসতেন।
রামকৃষ্ণ তাঁর অনুগামী ভক্তদের বলতেন ঠনঠনিয়ার কালী বড় জাগ্রত, তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের আরোগ্য কামনায় এখানে ডাব-চিনির নৈবেদ্য দিয়ে পুজোও দিয়েছিলেন। পরমহংসদেব অসুস্থ শরীরে শ্যামপুকুরে থাকাকালীনও এই মন্দিরে ঠাকুরের আরোগ্য কামনায় তার ভক্তেরা পুজো দিয়েছিল।
শ্রীশ্রী ঠাকুরের একটি প্রতিকৃতি বহুদিন ধরেই মায়ের গর্ভগৃহে পূজিত হয়ে আসছে। ঠনঠনিয়া কালীমন্দিরে এককালে ডাকাতদের প্রবল আধিপত্য ছিল। তারা, মায়ের কাছে পুজো ও বলি দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোত। তখন অবশ্য বর্তমান মন্দির নির্মিত হয়নি। মন্দির নির্মাণের পূর্বে দেবীমূর্তি পঞ্চমুণ্ডীর আসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
মন্দিরে দুটি গর্ভগৃহ, একটি কালীমা এবং অপরটি পুষ্পেশ্বর মহাদেব বিরাজ করছেন। মন্দিরে দুটি শ্বেতপাথরের ফলকে দেবীর প্রতিষ্ঠার সন-তারিখ এবং প্রতিষ্ঠাতার ও দেবীর নাম লেখা আছে। দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার ৩ বছর পর অর্থাৎ ১১১৩ বঙ্গাব্দ ১৭০৬ সালে পুষ্পেশ্বর মন্দিরটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দির চত্বরে বলিদানের জন্য হাড়িকাঠ রয়েছে। প্রতি অমাবস্যা ও বিশেষ পূজার দিনে এখানে পশুবলি হয়ে থাকে। পূর্ণ তান্ত্রিক মতে দেবীর পুজো হয়। কালীপুজো ছাড়াও ফলাহারিণী অমাবস্যা, রটন্তী চতুর্দশী প্রভৃতি বিশেষ পুজোয় এবং অমাবস্যায় দেবীর পুজো হয়ে থাকে। প্রতিবছর দেবীর অঙ্গরাগ হয়।
দেবী উত্তর কলকাতার ঘরের মেয়ে, দেবীর কাছে সকল মানত পূর্ণ হয় বলেই দেবীর নাম সিদ্ধেশ্বরী। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মন্দির থেকেই এই এলাকার নাম হয়েছে। এককালে জঙ্গলের মধ্য থেকে কালী মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনা যেত। ঠংঠং-ঠংঠং, সেই ধ্বনি থেকেই এলাকার নাম হয় ঠনঠনিয়া। আবার কারও কারও মতে, এলাকায় কামারশালা ছিল, সারাদিন লোহা পিটানোর শব্দ থেকেই এলকার নামকরণ হয়েছে। নাম যেভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক না কেন, এই মন্দির এলাকার ইতিহাসের অন্যতম নজির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায়, আজও প্রতি অমাবস্যার রাতে এই মন্দিরে দেবীর মায়াময় ঐশ্বরিক গন্তব্য পরিলক্ষিত হয়। দেবী ডাব চিনিতেই সন্তুষ্ট হন। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই কালীক্ষেত্র, আজ বাংলায় শক্তি আরাধনার পীঠস্থান হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।