রবীন্দ্রনাথের কথায় "কেরোসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক।" আলো আসার আগে ছিল অন্ধকারের দিন। কলকাতার রাস্তা জুড়ে অন্ধকারের মালা। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই সব যেন নিস্তব্ধ, নীরব হত।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকের সময়। কলকাতার বুকে তখনও আলো আসেনি।
লোডশেডিং-এর গল্প তখনো অজানা। তখন সন্ধ্যে বলতেই অন্ধকার ঘুলঘুলি। অনেক অজানা গল্প। রাস্তাগুলোই আলোর লেস মাত্র থাকত না বিকেলের পর থেকে।
ঊনিশ শতকের শুরুর আগে শহরের রাস্তায় কোন পথ-বাতি ছিল না। সন্ধ্যে নামলেই দরজা বন্ধ হতো গৃহস্থের। কুলুপ আঁটত সন্ধ্যের দরজা। কলকাতায় তখনো আলো ছিল না, আলো থাকলেও সন্ধ্যেবেলা শুধুমাত্র গৃহস্থের বাড়িতে রেড়ির বীজের তেলে প্রদীপ জ্বলত।
তা বলে কী রাতে কারোর বাইরে বেরোনোর দরকার পড়ত না? তখন উপায় কী হত! পাটকাঠির ওপর মশাল জ্বেলে নিতেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। সাধারণত কেউ অসুস্থ হলে বা কেউ বিপদে পড়লে প্রয়োজন পড়ত এই মশালের। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকজন একসঙ্গে বেরতেন, নইলে মশাল হয়ে উঠত সন্দেহের কারণ।
তারপর দিন বদলাল। আলো এলো কলকাতায়। তখন নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটা মাত্র রেড়ির বীজের দোকান থাকত, সন্ধ্যেয় বাড়ির অন্ধকার দূর করতে রেড়ির বীজের তেলই ছিল ভরসা। তার পাশে তারপর কেরোসিনের দেকান খুলল। এসেছিল কেরোসিনের বাতি। তবে সে ও বাড়ির জন্যে। চার দেওয়ালের মধ্যে আলো দেওয়ার ব্যবস্থা।
কলকাতার আগে যে শহরের রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছিল সে হল লন্ডন। ১৮০৭ সালে লন্ডনের রাস্তায় প্রথম গ্যাসবাতির আলো জ্বলে। ১৮২২ সালের ২২শে মার্চ একটি বাংলা দৈনিকে প্রথম লন্ডনের রাস্তায় আলো জ্বলার খবর প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা হয়- “ ইংলণ্ড দেশে নল দ্বারা একপ্রকার কল তৈরী হয়েছে, সেখান থেকে বায়ু নির্গত হয়ে রাত্রিকে আলোকিত করে।”
দৈনিক পত্রিকাটির খবর কলকাতা শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে আলোড়নের ফলাফল পেতে সময় লেগেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতার রাস্তায় আলো আসে। সে আলো ছিল গ্যাসবাতির আলো। শোনা যায়, কলকাতা পুরসভার মুটে সন্ধ্যে হতে না হতেই মই নিয়ে ল্যাম্পপোস্টে উঠত, তারপর ভাল করে কাপড় দিয়ে মুছে গ্যাস ভরত, তারপর দেশলাই দিয়ে আলো জ্বালাত। রাস্তার ঝলমলে দিনের গল্প শুরু তখন থেকেই।
আলো জ্বালাতে ব্যবহার করা হত কয়লার গ্যাস। সেই গ্যাস আসত ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি থেকে। পরে পাইপলাইনের মাধ্যমে উচ্চবিত্তের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল গ্যাসবাতি। শুরু হয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে।
এরপর গ্যাসবাতির আধিপত্যে হানা দেয় বৈদ্যুতিক বাতি। তখন ১৮৮৯ সাল। বৈদ্যুতিক বাতির রমরমা শুরু হয় তারপর থেকে। কলকাতায় প্রথম যে রাস্তা বৈদ্যুতিক আলোর সংস্পর্শে এসেছিল তা হল হ্যারিসন রোড অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী রোড। প্রায় তিন বছর ধরে এই রাস্তায় আলো বসানোর কাজ চলেছিল।
১৮৯৫ সালে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট পাস করেছিল তদানীন্তন বাংলার সরকার। তারপর বৈদ্যুতিক আলোকে আজ পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৮৯৭ সালের ৭ জানুয়ারি একুশবছরের জন্য শহরকে আলোকিত করার লাইসেন্স পেয়েছিল ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেডের এজেন্ট কিল্বার্ণ এন্ড কোম্পানি।
বিদ্যুতের আলোর খুঁটি পোঁতা নিয়ে রয়েছে নানান মজার কাহিনী। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সন্ধ্যে নামলেই কলকাতায় ব্ল্যাকআউটের কথা সমসাময়িক অনেকেরই জানা। সরকারি নির্দেশে আলকাতরা মাখানো টিনের ঘেরাটোপে ঢেকে দেওয়া হতো শহরের রাস্তার আলো। শত্রুপক্ষের বিমানের হাত থেকে শহরকে বাঁচানোর জন্যই নেওয়া হয়েছিল এই ব্যবস্থা।
এরপর বিদ্যুতের আলো নিয়ে চলেছে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নানান কারুকার্য। সেইসব সামলে আজও টিকে রয়েছে বৈদ্যুতিক আলো।