বারুইপুর, শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলিধন্য এক অন্যতম প্রাচীন জনপদ। এখানেই রয়েছে শক্তি পীঠ, শিবানী পীঠ, সেখানে পূজিতা হন দেবী কালী। বারুইপুর-কুলপি রোডের অনতিদূরেই সুবুদ্ধিপুর এলাকায় রয়েছে দেবীর মন্দির। মন্দিরে ফলহারিণী কালী পুজো, বিপত্তানিরী পুজো, রটন্তী কালী পুজো, এমনকি দুর্গা পুজোও হয়। ১৯৬৬ সালে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে স্বপ্নাদেশের কাহিনি।
স্থানীয় ভট্টাচার্য পরিবারের, নারায়ণদাস ভট্টাচার্য ও শান্তিলতা দেবীর কন্যা নিরুপমা চক্রবর্তী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। শ্বশুর বাড়িতে একদিন নিরুপমা দেবী স্বপ্নে দেখেন, তাঁর বাপের বাড়িতে পঞ্চাননের পুজো হচ্ছে। পঞ্চানন মন্দিরে পাশে পুকুরের মধ্যে একটি ঘট অবহেলায় পড়ে রয়েছে। স্বপ্নেই তিনি দেখেন, সেই ঘটটিকে তুলতে গেলে ঘটের মধ্য থেকে এক কালীমূর্তি আবির্ভূত হলেন এবং নিরুপমাদেবীকে নির্দেশ দিলেন, ঘটটি তুলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিছুদিন পর নিরুপমা দেবী বারুইপুর এলে, ফের একই স্বপ্নাদেশ পান। মা কালীর এই স্বপ্নাদেশের কথা শুনে নিরুপমা দেবীর জ্যেষ্ঠতাত দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ঘটটি খুঁজে পান। ১০ শ্রাবণ বাংলার ১৩৭৩ সনে মঙ্গলবার নবমী তিথিতে জল থেকে ঘট তুলে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানটির নাম হয় শিবানী পীঠ। নিরুপমা দেবী ছাড়াও, ভট্টাচার্য পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ অনুরূপা দেবীও স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। দুর্গাদাস স্বপ্নাদেশ পান যে তাঁর মেয়ের নামে মা কালীর নাম রাখতে হবে। সেই মতো শিবানীর নামেই মায়ের নাম হয়।
ঘট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় নানান অতিপ্রাকৃতিক জিনিসপত্র। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভট্টাচার্য বাড়ির প্রতিবেশী, একটি ছেলে বহুদিন নানা রোগে ভুগছিল। অনেক চিকিৎসা করেও ফল হয়নি। ছেলেটির মা দেবী মায়ের কাছে পুত্রের রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানান। ওইদিন দুপুরে নিরুপমা দেবী স্বপ্নে দেখলেন, মা বলছেন; পদ্মপুকুরে গিয়ে পুকুরের ওপারে পাঁচিলের পাশের রাস্তায় কড়ির দেখতে মিলবে। তা ছেলেটির গলায় পরিয়ে দিলেই ভাল হয়ে যাবে। স্বপ্নাদেশ মতো কড়ি পাওয়া যায়। কড়িটি রোগগ্রস্ত ছেলেটিকে পরানোর পর সে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। তখন থেকেই ছড়িয়ে পড়ে দেবীর কৃপা।
মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালিকা, দেবীর বিগ্রহ দারু নির্মিত। নিম কাঠের। সালঙ্কারা দেবী চতুর্ভুজা। বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় চার ফুট, বিগ্রহটি তৈরি করেন বারুইপুরের স্থানীয় শিল্পী। দেবীকে নিত্য আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগে থাকে সাদাভাত, ভাজা, তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। এখন বলিদান প্রথা বন্ধ। পীঠস্থানে কালীবিগ্রহ ছাড়া পারিবারিক নারায়ণ, গোপাল রয়েছেন, দু'টি শিবমন্দির রয়েছে কেদারনাথ ও বিশ্বনাথ। বাংলার ২৫ কার্তিক, ১৩৭৩ সনে ঘোর অমাবস্যায় দেবীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল মন্দিরে। দেবীর কালিকার হাতে থাকে রুপোর খর্গ, আরেক হাতে নর মুণ্ড। মাথায় অপরূপ রুপোর মুকুট। মায়ের ইচ্ছানুসারে তাঁর নামকরণ হল ভবাণী। শিবানী পীঠের মা ভবাণী। পদতলে বিরাজ করেন শ্বেত শুভ্র মহাদেব। একেবারে বাঙালির নিজস্ব শিব। দেবীর গাত্রবর্ণ কালো।
শিবানী পীঠের প্রতিষ্ঠাতা দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ছিলেন একজন সিদ্ধ পুরুষ। বারুইপুরের জমিদার রমেন্দ্র রায়চৌধুরী, কুলদেবতার সেবার জন্য ১৩০০ বঙ্গাব্দে লক্ষ্মীকান্তপুরের গোকর্ণি থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন। তাঁরা ছিলেন ভট্টাচার্য৷ ব্রাহ্মণদের তিনি তাঁর জমিদারিতে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। একটি পাড়ার নাম হয় ভট্টাচার্য পাড়া, সেখানেই ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণরা থাকতে শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের বাড়িতেই দুর্গাপুজো শুরু করেন। ভট্টাচার্যবাড়ির ছেলে অক্ষয় কুমার ভট্টাচার্য ১৯৩৯ সালে অক্ষয়কুঞ্জ তৈরি করেন৷ বাড়িতেই শুরু করেন দুর্গাপুজো। এই পুজো আজও নিষ্ঠার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁরাই শিবানী পীঠের প্রতিষ্ঠাতা।
কালী পুজোর দিন শিবানী পীঠ মন্দিরে অমাবস্যার পুণ্য তিথিতে মায়ের পুজো হয়। ভিড়ে উপচে পড়ে মন্দির। বছরের প্রতি দিনই মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা লেগে থাকে। স্থানীয়রা বলেন, সুবুদ্ধিপুরের মা শিবানী কখনও ভক্তদের খালি হাতে ফেরান না। মনের ইচ্ছা মায়ের সামনে প্রকাশ করলেই তা পূর্ণ হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, শিবানী পীঠের মায়ের মূর্তি নিঃশ্বাস নেন। ভক্তদের বিশ্বাস, মায়ের কাছে পুজো দিয়ে মায়ের পায়ের মাটি ও ফুল পাওয়া যায় তাহলে নাকি সেই ভক্তের কখনও শরীর খারাপ হয় না।