আজকের কালী কথায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক কালীর কথা। ডায়মন্ড হারবারের সুপ্রাচীন সরিষা কালীবাড়ি, মন্দিরের বয়স প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি। সরিষা আশ্রম মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সরিষা কালীবাড়িতে। তখন অবিভক্ত বাংলার মুড়াগাছার তদানিন্তন জমিদার বরদাপ্রসাদ রায়চৌধুরী দেবী কালীকার স্বপ্নাদেশ পেয়ে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায়, বরদাপ্রসাদ ছিলেন ধার্মিক ও শিবভক্ত। তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পাশাপাশি বহু মন্দিরের সংস্কারও করেন। রায়দীঘির সংস্কারও ছিলেন তিনি।
জনশ্রুতি রয়েছে, সরিষা গ্রাম এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চলে বসন্তরোগের প্রবল প্রকোপ দেখা দেয়। মহামারির আকার ধারণ করে বসন্ত। জমিদার বরদাপ্রসাদকে মা কালী স্বপ্নাদেশ দেন, সরিষায় দেবীর দারুবিগ্রহ নির্মাণ করে, মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পুজো করলেই রোগ নিরাময় ঘটবে। দেবীর স্বপ্নাদেশ মতো জমিদার ঘোলপুকুরে কাঠ ভেসে আসতে দেখেন। সেই কাঠ দিয়েই তিনি দেবী কালিকার বিগ্রহ গড়ান। সেই বিগ্রহকে আটচালা মন্দির নির্মাণ করে, প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপরই বসন্তরোগ নিরাময় হয়, মায়ের কৃপা ও মাহাত্ম্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সেই থেকে সরিষার আটচালা মন্দিরে মা কালী নিত্য পূজিতা হচ্ছেন।মায়ের মন্দিরের ডান পাশেই রয়েছে মায়ের পুকুর অর্থাৎ ঘোলপুকুর। এই পুকুরের জল সর্বদাই পরিষ্কার রাখা হয়, মায়ের পুজোয় পুকুরের জল ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, মন্দিরটি সম্ভবত ১৭৭০ সাল নাগাদ নির্মিত, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার কেশব রায়চৌধুরী মহাশয়, লক্ষীকান্তপুরের বিখ্যাত কেশবেশ্বর শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মায়ের প্রতিমা দারু নির্মিত, এই দারু বিগ্রহ যে সুপ্রাচীন তা বলা বাহুল্য। দারুবিগ্রহ আজও অক্ষত রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মায়ের বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়। এই মন্দিরের কালী বিগ্রহ বাংলার অন্যতম প্রাচীন ব্যতিক্রমী বিগ্রহ, কারণ বিগ্রহের পদতলে শায়িত শিবের ভঙ্গিটি বেশ অন্যরকম, যা অন্য কোথাও চোখে পড়ে না।
শোনো যায়, বরদাপ্রসাদ জমিদারির অধিকাংশ জমি ভাগ চাষিদের দিয়ে রেখে তাঁর ক্ষমতা কায়েম করেছিলেন। প্রায় ৩০০ বিঘা জমি পেরেল ও হালদারদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে পেরেলদের থেকে সমস্ত কিছুই কিনে নেন সন্তোষ কুমার হালদার। মন্দিরের মালিকানাও চলে যায় হালদার পরিবারের হাতে। অন্যমতে, মন্দিরে মায়ের নিত্যসেবার জন্য জমিদার বরদাপ্রসাদ রায়চৌধুরী, পেরেল ও হালদারদের ৩০০ বিঘা জমিদান করেছিলেন। পরবর্তীকালে হালদাররা পেরেলদের কাছ থেকে সেই জমি কিনে নেন এবং মন্দিরের কতৃত্বও হস্তান্তরিত হয় হালদারদের হাতে। আজও মন্দির ও মূর্তি দুই আগলে রেখেছেন হালদার পরিবারের উত্তরসূরিরা। ৩০০ বছর ধরে একই রীতিনীতি মেনে পুজো করে আসছেন হালদার পরিবার।
মন্দিরে মা নিত্য পুজো পান। তন্ত্রমতে, বিশেষ তিথিতে দেবীর পুজো হয়। এখানে বলি প্রথা প্রচলিত। দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোয় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ব্রাহ্মণ সেবায়েত পরিবার থেকে একটি করে ছাগবলির ব্যবস্থা করা হয়। মানতের পাঁঠাও বলি দেওয়া হয়। চৈত্র মাসে দেশমালা পুজো হয়, মেলা বসে।মায়ের নিত্য ভোগ হয়, প্রতিদিন অন্নভোগ দেওয়া হয়। কালীপুজোর সময় দেবীমূর্তির সামনে ছাগ-মাছ বলির রেওয়াজ রয়েছে। এছাড়া সবজিও বলি দেওয়া হয়। সেই বলির মাংস, মাছ ও সবজি নিয়ে মায়ের অন্নভোগের আয়োজন করা হয় মন্দিরে।
এই কালীমায়ের কারণে, সরিষা গ্রামে আর অন্য কোনও কালী পুজো হয় না। গোটা গ্রামে কালী প্রতিমা এনে পুজো করা নিষিদ্ধ। যতবারই কালীপ্রতিমা এনে পুজো করা হয়েছে, ততবারই কোনও না কোনও অঘটন ঘটেছে। কালী পুজোর দিন এই গ্রামে অন্য কোথাও কালী পুজো হয় না। আগে একাধিকবার গ্রামবাসীরা বারোয়ারি কালী পুজোর উদ্যোগ নিলে বিভিন্ন অঘটন ঘটেছে। স্থানীয়দের কাছে সরিষা কালীবাড়ির মা অত্যন্ত জাগ্রত। কাঠের কালীমূর্তিকে আজও পুজো করছেন সরিষা গ্রামের মানুষ।