বর্ধমান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শক্তিপীঠ। মানুষ বহু যুগ ধরেই শক্তির উপাসনা করে আসছে। মূলত দেবীদেরই শক্তির আধার হিসেবে আরাধনা করার রেওয়াজ। বর্ধমানে রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির। আদপে মা সর্বমঙ্গলা দুর্গারই আরেক রূপ।
বহুল প্রচলিত স্তোত্রে রয়েছে-
সর্বমঙ্গলা মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে,
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়নী নমস্তুতেঃ।
সৃষ্টি স্হিতি বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি,
গুনাশ্রয়ে গুনময়ে নারায়নী নমস্তুতেঃ।
শরনাগত দীনার্ত পরিত্রান পরায়নে,
সর্বস্বার্থে হরে দেবী নারায়নী নমস্তুতেঃ।
মঙ্গলকাব্যে জুড়ে রয়েছেন সর্বমঙ্গলা দেবী। রূপরামের ধর্মমঙ্গলে দেবীর কথা রয়েছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল ও রায়গুণাকর কবি ভারতচন্দ্রের কবিতায় দেবী সর্ব্বমঙ্গলার কথা জানা যায়। সমগ্র রাঢ় বঙ্গের দেবী হিসেবে সর্বমঙ্গলা পূজিত হতেন। বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সর্বমঙ্গলা।
-রাঢ় মধ্যে পূণ্য নাম হল বর্ধমান
সর্বমঙ্গলাকে নিয়ে যার যশো গান।
বর্ধমান স্টেশন থেকে কিছু দূরেই সর্বমঙ্গলা পাড়ায় ডি.এন. সরকার রোডে এই মন্দির অবস্থিত। রাঢ় বাংলার সর্বপ্রাচীন নবরত্ন মন্দির এটি। মনে করা হয়, এই মন্দিরের বিগ্রহ প্রায় ১০০০ বছরের পুরানো। দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তি কষ্টিপাথর নির্মিত। শোনা যায়, ১৭০২ সালে বা মতান্তরে ১৭৪০ সালে বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচাঁদ, এই মন্দিরটি তৈরী করেন। মা এখানে দক্ষিণমুখী। মন্দিরে গর্ভগৃহে রয়েছেন ধনেশ্বরী শক্তিদেবী ও ধনেশ্বর শিব। সেই মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা মহতীচাঁদের কন্যা ধনদেহি দেবী। ১৮৭৪সালের ২রা আষাঢ়। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর ১৯৫৯ সালে বর্ধমান রাজ উদয়চাঁদ মহতাব মন্দিরের জন্যে এক ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে দেন।
মন্দির প্রাঙ্গণে ৫টি শিব মন্দির রয়েছে, রামেশ্বর , কমলেশ্বর, চিত্রেশ্বর , চন্দ্রেশ্বর ও মিত্রেশ্বর। নাটমন্দির সংলগ্ন কারুমন্ডিত শিব মন্দির আছে তিনটি। দেবীর নবরত্ন মন্দিরের সামনের শিব মন্দিরটি হল মিত্রেশ্বর শিব মন্দির। তার দুপাশে রয়েছে আরও দুটি শিবমন্দির। অন্য দুটি আটচালা শিব মন্দির রাজা চিত্রসেনের আমলে নির্মিত হয়েছিল।
নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে রুপোর সিংহাসনে দেবী অধীষ্ঠিত। কষ্টিপাথরে খোদিত দেবী অষ্টাদশভূজা। মূর্তির পদতলে রয়েছে মহিষ। মহিষমর্দিনী মূর্তি এখানে সর্ব্বমঙ্গলা নামে পূজিত হন। মন্বন্তরা মূর্তি নামেও এই মূর্তি পূজিত হয়। অষ্টাদশভূজা মূর্তির হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, ভেদক বা বর্শা, তীর, ধনুক, ঢাল, তলোয়ার, ঘন্টা, কুঠার, দন্ড, সর্প, কমন্ডুল, বজ্র, রুদ্রাক্ষ। মন্দিরে সূর্যদেবের মূর্তি রয়েছে। তিনি নিত্য পূজিত হতেন। তবে মন্দিরের বিগ্রহ কোথা থেকে এল, কবে, কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা খুব নিশ্চিত করে বলা যায় না। দামোদরের পশ্চিম পাড়ে কোথাও কোনও এক মন্দিরে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। চুন প্রস্তুতকারকরা কোনও এক পুকুর থেকে গেঁড়ি, গুগলি, ঝিনুক, শামুক এসব চুন প্রস্তুতের সামগ্রীসমূহ নিয়ে যেত। একদিন হঠাৎ করেই তারা এক প্রস্তরখন্ড পায়। কৃষ্ণ বর্ণের ওই পাথরেই এক দেবীমুর্তি খোদিত রয়েছে।
তারা পাথরখন্ডটিকে স্থানীয় এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে নিয়ে যান। কথিত রয়েছে, ওই ব্রাহ্মণও দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। ইতিমধ্যে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেন রায় স্বপ্নে দেখেছেন এক দেবীমূর্তি তাঁকে আদেশ দিয়ে বলছেন, দেবী অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছেন। মহারাজ যেন দেবীকে উদ্ধার করে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাজ পরে ওই মুর্তির কথা জানতে পারেন। ব্রাহ্মণকে তলব করে মহারাজ বিগ্রহটি ব্রাহ্মণের কাছে চাইলেন। ওই ব্রাহ্মণ কিছুতেই মূর্তিটি দিতে রাজী হলেন না। তখন মহারাজ প্রতিশ্রুতি দিলেন, মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে ওই ব্রাহ্মণই দেবীর নিত্যপুজোর অধিকারী হবেন। পুজোর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন মহারাজ। ব্রাহ্মণ এতে রাজী হলেন। সেই থেকে আজও সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরে মা সর্ব্বমঙ্গলা নিত্য পুজো পেয়ে আসছেন। যেখান থেকে মুর্তিটি পাওয়া যায় সেই এলাকা বাহিরসর্ব্বমঙ্গলা পাড়া এবং সেই জলাশয় বাহিরসর্ব্বমঙ্গলা দীঘি নামে পরিচিত।
অন্য মতে, এক প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, বর্ধমানের বাহিরসর্বমঙ্গলা অঞ্চলে জেলেদের জালে একটি অদ্ভুত পাথর উঠে আসে। কিছুটা শিলার মত দেখতে সেই পাথর। সেই শিলা যে আদপে মূর্তি, তা বুঝতে পারেন স্থানীয় এক পুরোহিত। শোনা যায়, জালে ওঠার পর দামোদর লাগোয়া চুন তৈরির কারখানায় শিলামূর্তিটি চলে যায়। সেখানে শামুকের খোলের সঙ্গে পোড়ানো হলেও মূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। তখন স্বপ্নাদেশ পেয়ে বর্ধমানের তৎকালীন রাজা শিলামূর্তিটিকে নিয়ে এসে সর্বমঙ্গলা নামে পুজো শুরু করেন। অনেকের মতে ১০০০ বছর, আবার কারও মতে তা ২০০০ বছরের পুরনো। এই মূর্তিটি হল কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভূজা সিংহবাহিনী মহিষামর্দিনী। দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি, প্রস্থে আট ইঞ্চি।
এই মন্দিরের পুজোয় বিশেষ রীতি দেখা যায়, সকালে ৬ মন্দির খোলার পর মাকে মুখ ধুইয়ে সরবত খাওয়ানো হয়। তারপর হয় মঙ্গলারতি। মঙ্গলারতির পর চৌকিতে বসিয়ে তেল মাখিয়ে পঞ্চামৃত দিয়ে মাকে স্নান করানো হয়, মহাস্নান নামে পরিচিত। এরপর শাড়ী গহনা পরিয়ে মায়ের নিত্যপুজো চলে। জলখাবারে মাকে লুচি দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে অন্নভোগ দেওয়া হয়। মাকে ভোগঘরে নিয়ে গিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগে থাকে ভাত, দুরকম ভাজা, ডাল, দুরকম ব্যঞ্জন, চাটনি, পায়েস এবং মাছের টক। ভোগের পর মাকে পান সেজে দেওয়া হয়। তারপর শয়ান দিয়ে মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলে মন্দির খোলে, রাতে লুচিভোগ দেওয়া হয়। সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরের দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত মায়ের বিশেষ পুজো হয়। বর্ধমান শহরের কৃষ্ণসায়র থেকে রথে চাপিয়ে মায়ের ঘট আনা হয়। মহালয়ার পরের দিন দেবী সর্বমঙ্গলার জন্য ঘট আনার নিয়ম। নবমী পর্যন্ত পুজো চলে। একদা মন্দির চত্ত্বরের কামান দেগে অষ্টমীর সন্ধিপুজো শুরু হত। নবমীতে পাঁঠা ও মেষ বলি হত, এখন চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। দুর্গা পুজোর পাশাপাশি এই মন্দিরে কালী পুজো, বাংলা নববর্ষ, নবান্ন, শিবরাত্রি, বিপদত্তারিণী পুজো মহাসমারোহে পালিত হয়। ভক্তের বিশ্বাস মা খুবই জাগ্রত।