ভয় থেকেই ভক্তি আরাধনার আরম্ভ। ওলাওঠা অর্থাৎ কলেরা থেকে রক্ষা পেতে ওলাই দেবীর পুজো, বসন্ত নিবারণে শীতলা পুজো, তেমনই জ্বর থেকে রক্ষা পেতে জ্বরাসুরের পুজো, মহামারী থেকে বাঁচতে দেবী খচ্চরবাহিনীর পুজো; এসব দেখেছে বাংলা। তেমনই মন্বন্তর, দুর্ভীক্ষ থেকে রক্ষা পেতেও পুজো শুরু হয়েছিল বাংলায়। আজও সেই পুজো হয়ে আসছে। রামপ্রসাদের স্মৃতিধন্য হালিশহরে পূজিতা হন দেবী রুদ্রভৈরবী। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বা ১৭৭০ সালের বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হালিশহরের বকুলতলার বাজারপাড়ার রুদ্রভৈরবীতলায় শুরু হয় রুদ্র ভৈরবীর পুজো। এ বছরও ২৫ মে থেকে ৩০ অবধি চলবে দেবীর পুজো।
সমগ্র বাংলার মতো তদানিন্তন হাভেলীশহর অর্থাৎ আজকের হালিশহরেও ছড়িয়ে পড়েছিল দুর্ভীক্ষ।
দুর্ভীক্ষপীড়িত মানুষজন এক তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হন, উদ্দেশ্য ছিল পরিত্রাণের উপায়। তান্ত্রিক বলেন, দেবী রুষ্ট হয়েছেন বলেই প্রকৃতি এমন ধারণ করেছে। দেবীর রুদ্র রূপ রুদ্রভৈরবীর উপাসনা করলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে প্রকৃতিকে আবার সুজলা সুফলা করে তুলবেন, এমন নিদান দেন ওই তন্ত্র সাধক। দেবীর রূপ ও পূজাপদ্ধতি বিষয়ে পরামর্শও দেন তিনি। হালিশহরের রামসীতাগলি নিবাসী রামদুলাল চক্রবর্ত্তী বাজারপাড়ায় দেবীর পুজোর জন্য জমিদান করেন। সেই জমিতেই শুরু হয় দেবী রুদ্রভৈরবীর আরাধনা। জায়গাটি রুদ্রভৈরবীতলা নামে খ্যাত।
১৮৮৩-৮৪ নাগাদ হালিশহরে ভয়াবহ ম্যালেরিয়ার প্রদুর্ভাব ঘটে। বহু মানুষ প্রাণ হারান। প্রাণের ভয়ে হালিশহর ত্যাগ করেন অনেকে। রুদ্র ভৈরবীর পুজোর ছেদ পড়ে। প্রায় ৬০ বছর পর ফের ভরে উঠল হালিশহর। এবার মানুষ রুদ্রভৈরবীতলা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠল। অনেকেই রুদ্রভৈরবীতলা নামকরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইল। প্রবীণরা কেউ কেউ কিছু কিছু বললেন কিন্তু বিস্তারিত জানা গেল না। দেবীর রূপ ও পুজো পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে, রামপ্রসাদের মন্দিরের তৎকালীন পুরোহিত পণ্ডিত শিবকুমার ভট্টাচার্যের কাছে গেলেন একদল। শিবকুমার ভট্টাচার্য ভাটপাড়ার বিখ্যাত পণ্ডিতসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ তখন রুদ্রভৈরবী দেবী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন।
কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা অর্থাৎ দশমহাবিদ্যার মধ্যে পঞ্চম দেবী হলেন ভৈরবী। শ্রী শ্রী চণ্ডী গ্রন্থে দেবীর ধ্যানমন্ত্র রয়েছে। দেবী ভৈরবীর শ্রীঅঙ্গের কান্তি সহস্র উদয়কালীন সূর্যের ন্যায়, তিনি রক্তবর্ণা, রক্তবস্ত্রপরিহিতা। তাঁর কন্ঠে মুণ্ডমালা, বক্ষোদেশে রক্তচন্দন। তিনি কমলাসনা এবং তাঁর মাথায় চন্দ্রের সঙ্গে রত্নময় মুকুট শোভিত হয়। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে জপমালা, পুস্তক, বাকি দু-হাতে তিনি বর ও অভয় দায়ীনি। তাঁর মুখমণ্ডল ত্রিনয়নে শোভিত। কবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবীর রূপের বর্ণনা রয়েছে।
রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কমল-আসনা।
মুণ্ডমালা গলে নানা ভূষণভূষণা।।
অক্ষমালা পুঁথি বরাভয় চারি-কর।
ত্রিনয়ন অর্ধচন্দ্র ললাট-উপর।।
কুব্জিকাতন্ত্র বলে, দেবী সবরকম দুঃখ নাশ করেন। এমনকি দেবী রুদ্রভৈরবী যমযন্ত্রণাও বিনাশ করেন। দেবী কালভৈরবের ভার্যা। তাই তিনি ভৈরবী। তন্ত্রশাস্ত্রে ভৈরবীর একাধিক রূপভেদের পরিচয় পাওয়া যায়, যাঁদের মধ্যে ছয়টি রূপ ষট্ ভৈরবী নামে পরিচিত। তাঁরা হলেন -- সম্পৎপ্রদাভৈরবী, চৈতন্যভৈরবী, ষটকুটাভৈরবী, রুদ্রভৈরবী, ভুবনেশ্বরীভৈরবী ও অন্নপূর্ণাভৈরবী। তন্ত্র অনুযায়ী, দেবী তীব্র তেজোময়ী। তিনি রক্তবস্ত্র-পরিহিতা। তিনি দশভুজা, তাঁর দশটি হাতে রয়েছে ত্রিশূল, ডমরু, খড়্গ, খেটক বা ঢাল, ধনুক, তীর, পাশ, অঙ্কুশ, পুস্তক আর অক্ষমালা। শিবের নাভিপদ্মরূপ সিংহাসনে দেবী উপবিষ্টা। দেবীর এই রূপ প্রকৃতির রুদ্র রূপেরই প্রতীক। শিবকুমার নিজে হাতে দেবীর পুজোপদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক ক্রিয়া সম্পর্কে পুঁথি লিখেছিলেন। ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবীর মূর্তি তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি অর্থাৎ জামাই ষষ্ঠী থেকে দশহরা তিথি পর্যন্ত পাঁচদিন পুজোর তিথি হিসেবে নির্ধারিত হয়। ১৯৪৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের অরণ্যষষ্ঠীতে বাজারপাড়ার রুদ্রভৈরবীতলায় শিবকুমার ভট্টাচার্যের পৌরহিত্যে দেবী রুদ্রভৈরবী পুনঃপ্রতিষ্ঠিতা হলেন।
তন্ত্রমতে পূজিতা দেবী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হল। তাই ১৯৪৪ সালে পুজো যখন নতুন করে আরম্ভ হল, তখন রুদ্রভৈরবী পুজোর সঙ্কল্পে কেউ নিজের নাম যুক্ত করতে রাজি হলেন না। দেবীর পুজোয় ত্রুটি হলে দেবীর কোপ সঙ্কল্পকারীর উপর নেমে আসবে, এই ভয়ে বাজারপাড়ার অধিবাসীরা কেউই নিজের নামে সঙ্কল্প হতে দিলেন না। তখন দেবীর নামেই পুজো শুরু হল। কিছু বছর পর বাজারপাড়ানিবাসী নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা বৃদ্ধা পত্নী নিজের নামে দেবীপুজোর সঙ্কল্প করালেন। সেই পথ অনুসরণ করে পরবর্তী কিছু বছর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধবৃদ্ধাগণের নামে সঙ্কল্প করে পুজো অনুষ্ঠিত হল। তারপর দেবী পুজোর সঙ্কল্প আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাখা হল না, গোত্র ধরে ধরে সকল পল্লীবাসীর নামেই সঙ্কল্পের ব্যবস্থা করা হল।
প্রতি বছর অরণ্যষষ্ঠী থেকে দশহরা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে ষোড়শোপচারে দেবী রুদ্রভৈরবীর পুজো হয়। এখানে ডাবের জলে আদার রস মিশিয়ে, তা কারণবারির বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অষ্টমীতে হয় রুদ্রযামলতন্ত্রের অন্তর্গত শ্রীশ্রীরুদ্রচণ্ডী পাঠ হয়। নবমীতে বিশেষ যজ্ঞ হয়, ১০৮ বেলপাতা ও ১০৮ নীল অপরাজিতা আহুতি দেওয়া হয়। পুজোয় বলিদানের চল নেই। পাঁচ দিনের উৎসবে মেতে ওঠে গঙ্গা তীরবর্তী জনপদ।