শেওড়াফুলি থেকে উত্তর কলকাতা, দেখা মিলবে বেশ কয়েকটি নিস্তারিণী মন্দিরের। আজ রানাঘাটের নিস্তারিণী কালী মন্দিরের কথা বলব। আদপে দেবী নিস্তারিণী হলেন কালিকার আরেক রূপ। নিস্তারিণী পুজো দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় হয়ে আসছে, রীতিমতো লোকাচারে পর্যায়ে নিস্তারিণী আরাধনা চলে আসছে। যাদের বাড়িতে কাসুন্দি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে, তারা; তৈরি হওয়ার পর প্রথম কাসুন্দি দেবী নিস্তারিণীকে উৎসর্গ করেন। সেদিন নিরামিষ খাওয়ার নিয়ম। এইভাবেই বাংলার লোকাচারে মিশে রয়েছেন দেবী নিস্তারিণী।
আজ রানাঘাটের নিস্তারিণী মায়ের মন্দিরের কথা বলব। রানাঘাট নামের বুৎপত্তি সম্পর্কে বলা যায়, কিংবদন্তি বলে আরকি! রানা ডাকাতের ঘাঁটি থেকেই রানাঘাট নামের জন্ম। ডাকাতের ঘাঁটি যখন কালী পুজো তো হবেই। ঠিক সেভাবেই রানাঘাটে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কালী মন্দির। রানাঘাটের বড়বাজার এলাকায় রয়েছে নিস্তারিণী মায়ের মন্দির। রানাঘাটের জমিদার পাল চৌধুরী পরিবারের রতনচন্দ্র পাল চৌধুরীর পত্নী উজ্জ্বলমণি দাসী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রতনচন্দ্র ও উজ্জ্বলমণি ছিলেন নিঃসন্তান। রতনচন্দ্র পাল চৌধুরীর মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরেরও আগে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। তদানিন্তন সময়ে মন্দির তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৭৫ হাজার টাকা।
১২৪২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ ৩২ শে জ্যৈষ্ঠ বিশেষ পুজো করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নির্মাণ সম্পূর্ন হতে প্রায় নয় বছর সময় লেগেছিল। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর উজ্জ্বলমণি দাসী, তাঁর ভাসুর ও দেওরের ছেলেদের হাতে মন্দিরের ভার তুলে দেন। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মাতৃমূর্তি কষ্টিপাথর নির্মিত। একটি পাথর থেকেই মূর্তি তৈরি হয়েছে। বলা হয়, এই মন্দিরের অনুকরণেই দক্ষিণশ্বর মন্দির তৈরি হয়েছে। একদা রানী রাসমণির জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস নদীপথে চূর্নী নদী দিয়ে কৃষ্ণনগর যাচ্ছিলেন তখন এই মন্দির দেখে তিনি নৌকো দাঁড় করিয়ে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং রানী রাসমণিকে সব কথা জানান। সে সময় দক্ষিণেশ্বর নির্মাণ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হচ্ছে। এই মন্দিরটি নবরত্নশৈলির, কিন্তু দালান রীতিতে নির্মিত। মন্দিরে কিছু নকল জানলার নকশা করা রয়েছে। দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় এখানে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুজো দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রতি জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তিতে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ পুজো হয়, তাছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় মায়ের পুজো হয়। মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠ রয়েছে, যদিও পশুবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। পুজোর সময় আখ, চালকুমড়ো ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়৷
মন্দিরের চূড়া দ্বিতল বিশিষ্ট, চারটি করে রত্ন এবং শীর্ষে একটি; সব মিলিয়ে নটি। গর্ভগৃহে বেদীর ওপর প্রস্ফুটিত পদ্মদলের মধ্যে শায়িত শিবের ওপর দণ্ডায়মান মা কালীর মূর্তি। মাতৃ মূর্তিতে কোনও উগ্রতা নেই, শান্ত, স্নিগ্ধ রূপে মা এখানে বিরাজ করছেন। এই মন্দির ১৮৩৪-৩৫ সাল নাগাদ তৈরি। অর্থাৎ দুশো বছরের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলতে এখনও কিছু বাকি। কিন্তু প্রায় ১৯০ বছর যাবৎ নিস্তারিণী কালী পূজিতা হচ্ছেন এখানে।