শরতে শারদীয়া, বসন্তে বাসন্তী সারা বছর জুড়েই পূজিতা হন দেবী দুর্গা। তেমন মাঘ মাসে শীতের বিদায় বেলায় পুজো পান রাজ রাজেশ্বরী। মুর্শিদাবাদ জেলার সুতির বংশবাটি গ্রামের অন্যতম সেরা উৎসব হল রাজ রাজেশ্বরী দুর্গোৎসব। এই পুজো উপলক্ষ্যে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ। মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার মানুষ ভিড় জমান। মেলা বসে, যাত্রা, বাউল, নাটক ও কবিগানের আসর বসে। রাজ রাজেশ্বরী দুর্গোৎসব সম্প্রীতির উৎসব। হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে সামিল হন।
বীরভূম লাগোয়া মুর্শিদাবাদের সুতির বংশবাটি গ্রামে সরস্বতী পুজোর পরের দিন থেকে রাজ রাজেশ্বরী মায়ের পুজো শুরু হয়। পরবর্তী পূর্ণিমা অর্থাৎ মাঘী পূর্ণিমা অবধি চলে পুজো। পূর্ণিমা তিথিতে মায়ের পুজো চলে। নবমী তিথিতে সর্বাধিক সমাগম হয়। আদপে রাজ রাজেশ্বরী হলেন দেবী দুর্গার ষোড়শী রূপ। দেবী শবাসনে বিরাজমানা। মাঘের শেষে মুর্শিদাবাদ মেতে ওঠে রাজরাজেশ্বরীর আরাধনায়। প্রায় তিন শতাব্দীজুড়ে মাঘ মাসে মুর্শিদাবাদের সুতি বংশবাটি এলাকায় পূজিত হন রাজরাজেশ্বরী। মা রাজরাজেশ্বরী দুর্গারই আরেক রূপ। প্রায় ৩০০ বছর ধরে বসন্তকালে দুর্গা পুজা হয় বংশবাটি গ্রামে। প্রতি বছর এই সময়টাতে, ষষ্ঠী থেকে দশমী পাঁচ দিন ধরে মায়ের আরাধনা চলে। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম, নদিয়া , ঝাড়খণ্ডসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষ মাকে দর্শন করতে আসেন। পুজো উপলক্ষ্যে বড় মেলাও বসে।
জনশ্রুতি রয়েছে, বহুকাল আগে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল বংশবাটি। তখন রাজুয়া দীঘি, অর্থাৎ একটি জলাশয় থেকে দেবী রাজরাজেশ্বরী উঠে এসে গোটা গ্রামকে রক্ষা করেন। তারপর থেকেই দেবী রাজরাজেশ্বরী, ওই গ্রামে দুর্গা হিসেবেই পূজিতা হয়ে আসছেন। দেবী রাজরাজেশ্বরী হলেন মা দুর্গার ষোড়শী রূপ তথা দশ মহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ। দেবী প্রতিমা কাঠামোতে শব রূপী শিব শায়িত থাকেন। শিবের নাভি থেকে প্রস্ফুটিত হয় দুটি পদ্ম। দেবী রাজরাজেশ্বরী শবাসনে বিরাজ করেন আর ধরিত্রীকে ধারণ করে থাকেন চতুর্মুখী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং ধর্মরাজ। মা রাজরাজেশ্বরী চতুর্ভূজা, তাঁর দু-পাশে থাকেন দুই সখী জয়া এবং বিজয়া। দেবীর বাহন সিংহ। তিনিই আবার দশ মহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ।
লোকমুখে শোনা যায়, জনৈক ভবানন্দ ভট্টাচার্য নামে এক নিঃসন্তান দম্পতি রাজুয়া দীঘির পাড়ে দেবী রাজরাজেশ্বরীর দেখা পেয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারেই শুরু হয় এই পুজো। সেই পুজোই এখন বারোয়ারি পুজোর আকার ধারণ করেছে। তৈরি হয়েছে মাতৃ মন্দির। মন্দিরের হাতে থাকা জমিতে উৎপন্ন ধান, পুকুরের মাছ বিক্রি করে এবং আমজনতার চাঁদায় মন্দিরের পুজো হয়। এই পুজো সম্প্রীতির পুজো, প্রতি বছর এই পুজোকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলন মেলা বসে। এখানে দশমীর দিন দেবী রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জন হয় না। দশমী শেষে পূর্ণিমা পার করে কোনও এক শুভদিনে দেবীর বিসর্জন হয়। ভক্তদের কাঁধে চেপে দেবীকে নিরঞ্জনের জন্য রাজুয়া দীঘিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্য মতে, বহু বছর আগে স্থানীয় রাতুরি গ্রামের এক শাঁখারি রোজগারের আশায় অন্য কোনও গ্রামে যাচ্ছিলেন। পথে এক তরুণী তাঁর কাছে শাঁখা পরতে চান। শাঁখা পরানোর পর টাকা চাইতেই ওই তরুণী বলেন, তিনি ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে, ভবানন্দ ভট্টাচার্য তাঁর বাবা। শাঁখারি যেন তাঁর কাছে টাকা নিয়ে নেন। শাঁখারির কথা শুনে অবাক ভট্টাচার্য দম্পতি। কারণ তাঁরা নিঃসন্তান, তাঁদের মেয়ে আসবে কোথা থেকে? তড়িঘড়ি রাজুয়া দীঘির পারে ছুটলেন ভট্টাচার্য দম্পতি। দেখলেন, শাঁখা পরিহিতা এক কন্যা রাজুয়া দিঘির মধ্যে চলে যাচ্ছে। তিনিই মা রাজ রাজেশ্বরী, সেই থেকে শুরু মাতৃ আরাধনা। বংশবাটি গ্রামের ভট্টাচার্য বাড়ির সেই রাজ রাজেশ্বরীর পুজো আজ সর্বজনীন।
ধরমপুরগ্রামেও রাজ রাজেশ্বরী পুজো হয়। গ্রামটি কৃষি ভিত্তিক গ্রাম, রাজ রাজেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করেই গ্রামের ষষ্ঠীতলা, কালীতলা, মনসাতলা গড়ে উঠেছে। এক চালার মূর্তি রাজ রাজেশ্বরী গ্রামবাসীদের ঐশ্বর্য ও আরোগ্যের ধারক-বাহক। সেই কারণেই তিনি রাজ রাজেশ্বরী। এখানে পুজো হয় জৈষ্ঠ্য মাসে। জামাই ষষ্ঠী তিথির পরে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী চারদিন ধরে এই পুজো হয়। এই পুজো ঘিরেই গ্রামের মাঝখানে রয়েছে রাজ-রাজেশ্বরী তলা। কার্তিক মাসে গ্রামের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর প্রান্তের মাঠে যখন কচি ধানের শিষে পাক ধরে তখন থেকে মাঠ পাহারা দেওয়ার জন্য প্রতি মাঠের আট জন করে দল তৈরি হয়। গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে সেই দল গঠিত হয়। সেই মাঠ পাহারা দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী রাজ-রাজেশ্বরী মায়ের পুজোর জন্য ধান দিতে হয় মাঠ পাহারাদের। সেই ধান বিক্রির টাকায় মায়ের পুজোর খরচ জোগাড় হয়। দেবী এখানে ত্রিপুরেশ্বরী রূপে পূজিত হন। শাক্ত মতে পুজো হয় বলে, এখানে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। সপ্তমীর সকালে গ্রামের কালীসাগরে মঙ্গলঘটে জল ভরে রাজ রাজেশ্বরী মায়ের পুজো শুরু হয়। যদিও এই পুজোর বৈশিষ্ট্য হল, পুজো শেষ হওয়ার পর বৃষ্টি না হলে মূর্তি বিসর্জন করা হয় না। বৃষ্টির পরেই দেবীকে কালীসাগরের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়।
উত্তরবঙ্গেও রাজ রাজেশ্বরী পুজোর চল রয়েছে। ওপার বাংলাতেও রাজ রাজেশ্বরীর মন্দির রয়েছে। কোথাও কোথাও কালীকে রাজ রাজেশ্বরীর বেশে পুজো করা হয়। যেমন তারাপীঠেই মা তারাকে রাজরাজেশ্বরী বেশে সাজানো হয়। পাঁচরকম ভাজা, পোলাও অন্ন, পায়েস দিয়ে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। শোলমাছ পোড়া মাকে দেওয়া হয়। নিশিপুজো হয় রাতে। কালরাত্রি, মহারাত্রি। তারাপীঠে বিশেষ পুজো উপলক্ষ্যে দেবীকে সোনার অলঙ্কার, মুন্ডুমালা, ডাকের সাজ, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়। মায়ের জন্যে বিশেষ ভোগেরও আয়োজন করা হয়। বলিদানের মাংস মাকে নিবেদন করা হবে। নিশিপুজোর পর মহাশ্মশানে শেয়ালের জন্য ভোগ দেওয়া হয়। ষোড়শ উপাচারে দেবীর আরাধনা করা হয়। মাকে বেনারসিতে সাজানো হয়।