কলকাতার দক্ষিণাংশের বিখ্যাত জনপদ হল টালিগঞ্জ। ১৭৭৫-৭৬ সাল নাগাদ কলকাতা এবং ওপার বাংলা ও আসমের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার উদ্দেশ্যে মেজর টলি সাহেব, একটি নালা খননের সিদ্ধান্ত নেন। সেই টালির খনন করা নালার নাম হয় টালির নালা। এই নালার ধারেই গড়ে ওঠে গঞ্জ যা পরবর্তীকালে টলিগঞ্জ নামে পরিচিত হয়৷ টালিনালা ছিল এক সমৃদ্ধ জলপথ, যার দু'ধারে জনবসতির সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মন্দির গড়ে উঠেছিল। যেমন গড়ে উঠেছে কালি মন্দির ও তেমন গড়ে উঠেছে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির, কৃষ্ণের মন্দিরে রাধা ও তার মাধব দুই স্থান পেয়েছে।
তেমন ওই চত্বরের একটি বিখ্যাত মন্দির হল রাধাকান্ত মন্দির। টালিগঞ্জের চেতলা এলাকায়, মন্ডল টেম্পেল রোড আর চেতলা রোডের সংযোগস্থলে রয়েছে এই মন্দির। এটি বাওয়ালির মন্ডল পরিবারের মন্দির। মন্ডল পরিবারের গৃহদেবতা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই এই আদিগঙ্গার ধারে তারা বেশ কয়েকটি রাধামাধব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরগুলোর মধ্যে রাধাকান্ত মন্দিরটি নবরত্ন অর্থাৎ নয়টি চূড়া বিশিষ্ট। রাধনাথ মন্দিরটি ১১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, যদিও অন্য মতে মন্দিরের উচ্চতা ৯১ ফুট। বজবজের বিখ্যাত বাওয়ালি জমিদার রামনাথ মন্ডল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটিতে বাংলার নবরত্ন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। সারা মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ফুলের কারুকার্য। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি বড় নাটমন্দির।
এই মন্ডল পরিবারের ইতিহাস সুদীর্ঘ। একদা দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাওয়ালির মন্ডল পরিবারের পদবি ছিল রায়। ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকে এই পরিবারের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ বাসুদেব রায়ের পৌত্র শোভারাম মন্ডল উপাধি লাভ করেন। শোভারামের নাতি রাজারাম ছিলেন হিজলীর রাজার সেনাপতি ছিলেন। হিজলীর রাজা রাজারামের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বাওয়ালী ও বজবজ অঞ্চলের ৫০টি গ্রামের মালিকানা পুরস্কার স্বরূপ দেন। মনে করা হয়, ১৭১০ সালে থেকে রাজারামরা বাওয়ালিতে বসবাস শুরু করেন। রাজারামের পৌত্র বিপুল ধন সম্পত্তির অধিকারী হন। ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তারা শোভারামের পথ অনুসরণ করে পরবর্তীকালে বহু মন্দির নির্মাণ করেন। আঠারো শতক ক্লাইভ, মন্ডল পরিবারকে কলকাতায় বসবাসের জন্য আহ্বান জানান। রামনাথ ও মানিক মন্ডল ক্লাইভের ডাকে সাড়া দিয়ে টালি নালার অর্থাৎ আদি গঙ্গার তীরবর্তী অধুনার চেতলা-টালিগঞ্জ অঞ্চলে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। রামনাথ ও মানিক মন্ডল উভয়েই বংশ পরম্পরায় টালি নালার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেন।
মন্ডলদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরগুলির মধ্যে রামনাথ নির্মিত চেতলা-টালিগঞ্জ এলাকায় ৯১ফুট উঁচু রাধানাথ মন্দির অন্যতম। বাংলায় এত উঁচু মন্দির বিরল। নবরত্ন শৈলীর মন্দিরটি নির্মাণ কাল অনুমানিক ১৭৯৩ সালে শুরু হয়েছিল, ১৮০৯ সাল নাগাদ তা সম্পূর্ণ হয়। টালিগঞ্জের দিক থেকে আদি গঙ্গা পেরিয়ে চেতলা রোড বরাবর এগোলেই বাদিকে পড়বে নবরত্ন রাধানাথ মন্দিরের। মন্ডল পরিবারের কূলদেবতা রাধাকান্তের নামে মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। কষ্ঠিপাথরের রাধাকান্ত এবং অষ্ট ধাতুর রাধা বিরাজ করেন মন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণ ও অন্যান্য কয়েকটি বিগ্রহ রয়েছে মন্দিরে। মন্দিরটি দ্বিতল বিশিষ্ট। মন্দিরের গাত্রে পাথরের ফলক থেকে জানা যায়, মন্দিরটির কাজ শুরু হয়েছিল ১৭৯৩ সালে, যা শেষ হয় ১৮০৭ সালে। মন্দিরে রয়েছে তিনটি মূর্তি, যা ১৮০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুর্তিগুলোর মধ্যে রাধকান্ত মূর্তিটি কষ্টিপাথরের, রাধা ও লক্ষীনারায়ণের মূর্তিদুটি অষ্টধাতুর তৈরি। প্রস্তরফলকে প্রাচীন বাংলায় লেখা। সনগুলি শকাব্দে।
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ শকাব্দা ১৭১৮।
শাকেষ্টদশ বাজিচন্দ্রগণিতে কুম্ভস্থিতে ভাস্করে।
রাধকান্ত মুদে শুভাশয় সুতে গঙ্গোপকণ্ঠস্থলে।
আরবধ্বং নবরত্ন মতেদমলং তদ্রামনাথেন দাসেনা
সমি ১৭২৯ নব যুগ্ম মৈত্রী বিমিতে পূনতুত্ত্ব মাগান্নধৈ।।
ইতি পুনশ্চ ১৭৩১ ত্রিসং ক্রান্তানাং সর্বব পূর্ণ ত্বমগাত।।
মন্ডল পরিবারেরই দুটি রাজবাড়ি রয়েছে, তার মধ্যে একটি বড়, যা বড় রাজবাড়ি নামে পরিচিত। অন্যটি তুলনামুলক ছোট, যা ছোট রাজবাড়ি। ছোট রাজবাড়ির একাংশে রয়েছে একটি বড় মন্দির চত্বর যা বাওয়ালি বংশের সন্তান পেয়ারিলাল মন্ডল ও মণিমোহন মন্ডল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণ সাদা কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। রয়েছে একটি নবরত্ন ও দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির এবং তিনদিক ঘেরা দ্বাদশ শিব মন্দির। নবরত্ন মন্দিরটিতে গোপাল জিউ ও শ্যামসুন্দর পূজিত হন। বড় রাজবাড়িতেও রয়েছে দুটি মন্দির চত্বর। একটি আটচালা মন্দির এবং সেখানেও রয়েছে ১২টি মন্দির নিয়ে। এখানে জাঁকজমকপূর্ণভাবে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবিঃ প্রতীকী