বিপুলা বঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য রাধাকৃষ্ণ মন্দির। তাদের নাম বিভিন্ন কোথাও রাধাবল্লভ, কোথাও রাধাগোবিন্দ। তেমনই এক মন্দির হল রাধাবিনোদ মন্দির। বীরভূম জেলার জয়দেব-কেন্দুলী গ্রামে অজয় নদের তীরে এই মন্দির অবস্থিত। প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির দিন লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। মেলা বসে। মকর স্নান উপলক্ষ্যে বহু মানুষের সমাগম হয়। তীর্থক্ষেত্রের পাশাপাশি মন্দিরটি অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শনও বটে। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। কুলুঙ্গির মধ্যে খোদাই করা রয়েছে রামায়ণ মহাভারত এবং শ্রীকৃষ্ণের নানান কাহিনী। এই মন্দিরে রাধাবিনোদের নিত্য পুজো করা হয়। জনশ্রুতি অনুসারে মন্দিরটি জয়দেবের বাস্তুভিটের উপর নির্মিত।
কথিত আছে, গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেবের জন্ম হয়েছিল বীরভূমের কেন্দুলি গ্রামে। গীতগোবিন্দের ভনিতায় জয়দেব লিখেছেন, কেন্দুবিল্বসম্ভবরোহিণীরমণ। অর্থাৎ, কবি জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুবিল্ব গ্রাম। সেটিই কেন্দুলি। তিনি ছিলেন লক্ষণ সেনের সভাকবি। কবি জয়দেব ছিলেন রাধাবিনোদের পরম ভক্ত। জনশ্রুতি রয়েছে, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মন্দির তৈরি করা হয় ১৬৮৩ সালে। কবি যে আসনে বসে পূজা করতেন সেই আসন সংরক্ষিত আছে বলেই জানা যায়। একদল গবেষকের দাবি, বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের সভাকবি যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন বর্ধমানের মহারানী। আবার আরও কিংবদন্তি অনুযায়ী বর্ধমানের রাজা কীর্তি চাঁদ মন্দির গড়েছিলেন।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল নিয়েও নানা মুনির নানা মত রয়েছে। ১৬৮৩, ১৬৮৪, ১৬৯২, ১৬৯৪ নানা সালের কথা রয়েছে। মন্দিরের ফলকে রয়েছে, বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ ১৬৮৩ সালে মন্দির নির্মাণ করেন। নির্মাণকাল ১৬৮৩ হলে বলতে হয়, মন্দিরটি কৃষ্ণরাম রায়ের আমলে নির্মিত হয়েছে। কারণ কৃষ্ণরামের শাসন কাল ছিল ১৬৭৫ - ১৬৯৬ সাল পর্যন্ত। কথিত আছে, মন্দিরটি বিখ্যাত কবি জয়দেবের আবাসস্থলে প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাবর্ষ নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন রাধাবিনোদ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবর্ষ নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করে বলেছেন সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক। বর্ধমান রাজপরিবারের কৃষ্ণরাম রাই জমিদারি লাভ করেন পিতা ঘনশ্যাম রাইয়ের মৃত্যু ১৬৭৫-এর পর। কৃষ্ণরাম রাই প্রয়াত হন ১৬৯৬-এ। সুতরাং রাধাবিনোদ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবর্ষ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ লিখিত ১৬৮৩ ধরলে সেটি কৃষ্ণরাম রাইয়ের জীবৎকাল। কৃষ্ণরামের পর জমিদারি পান তাঁর পুত্র জগৎরাম রাই। তিনি প্রয়াত হন ১৭০১। পরবর্তী রাজা হন কীর্তিচন্দ রাই (১৭০২-১৭৪০)।
ভিত্তিবেদির উপর দক্ষিণমুখী নবরত্ন মন্দির অবস্থিত। গর্ভগৃহে দুটি দরজা রয়েছে। খিলানগুলির উপর ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, বায়ু, যম, ইন্দ্র ও দশাবতারগণের মূর্তি রয়েছে। রামরাবণের যুদ্ধ, সীতা উদ্ধারের দৃশ্য রয়েছে। গর্ভগৃহে রাধাবিনোদ ও রাধিকা বিগ্রহ রয়েছে।মন্দিরটি বর্গাকার এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপ ২৫ ফুট করে। মন্দিরটির সামনের দিকে আছে ত্রিখিলান প্রবেশপথ। জগমোহনের মাঝে গর্ভগৃহে প্রবেশপথ একটি। গর্ভগৃহে আছেন রাধাবিনোদ। ডান দিকে আছেন রাধাসহ প্রাণনাথ। রাধাবিনোদের বাঁদিকে পদ্মাবতী এবং ডানদিকে আছে জয়দেবের মূর্তি। মন্দিরের সামনের দিকের অংশটি টেরাকোটার অপূর্ব অলংকরণে সমৃদ্ধ। মাঝের খিলানের একেবারে ওপরে উৎকীর্ণ আছে রাম-রাবণের যুদ্ধের টেরাকোটা ফলক। তার নিচে আছে বানর সেনাদের যুদ্ধের দৃশ্য। ডানদিকেও রামায়ণের কাহিনি উৎকীর্ণ আছে। বড়ো টেরাকোটা ফলকটি হল মকর-রথসহ দশাননকে গলাধঃকরণ করার চেষ্টায় সুপার্শ্ব। আছে কুম্বকর্ণের বানর ভক্ষণ, বানর সেনা, তীরন্দাজ সৈন্যদের রণংদেহী মূর্তি। বাঁ-দিকের অর্থাৎ পশ্চিমদিকের খিলানের একেবারে ওপরে দুটি প্যানেলে আছে ব্রহ্মা বিষ্ণু, মহেশ্বর, বায়ু, যম, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা। তার নিচে দুটি প্যানেলে আছে বিষ্ণুর দশাবতার ফলক।
ত্রিখিলান প্রবেশপথের ডানদিকের পূর্ণ স্তম্ভের মাঝামাঝি আছে মহিষাসুরমর্দিনীর ফলক। বাঁ-দিকের পূর্ণ স্তম্ভের টেরাকোটা ফলকগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। সামনের দেওয়ালের বিভিন্ন ফলকে আছে নর্তকী, বাদ্যযন্ত্র বাদিকা, শালভঞ্জিকা, সাধক, জটাধারী সাধু, ফুলকারি নকশা। সামনে পূর্বদিকের মৃত্যুলতায় ৬টি এবং পশ্চিমদিকে মাত্র ৩টি ফলক আছে। বাকি অংশে টালি বসানো আছে। পিছনের পূর্বদিকের মৃত্যুলতায় আছে দ্বারপাল, রমণদৃশ্য। ওপরে ধনুকের মতো বাঁকা কার্নিশের নিচে দুই সারি ফলক আছে এবং প্রতি সারিতে আছে কুড়িটি করে কুলুঙ্গির ফলক। দু-দিকে প্রত্যেক সারিতে ১৪টি করে কুলুঙ্গির ফলক আছে দুই সারি করে। ত্রিখিলান প্রবেশপথের ওপরে ধনুকের মতো বাঁকা কার্নিশে ২৯টি টেরাকোটা ফলক আছে। ত্রিখিলানের দুপাশের অর্ধস্তম্ভের ওপর উল্লম্বভাবে আছে সাতটি করে এবং দুটি পূর্ণস্তম্ভের ওপর আছে নয়টি করে ফলক।
জয়দেবের জন্মস্থান নিয়ে মতানৈকি রয়েছে। ওড়িশার প্রাচী নদীতীরে অবস্থিত কেন্দুলী শাসনের কথা কেউ কেউ বলেন। লক্ষ্মণ সেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম ছিলেন ভোজদেব ও বামাদেবীর পুত্র জয়দেব। প্রায় ৩৫০ বছর আগে কবি জয়দেব এ মন্দিরের অলিন্দে কদমখন্ডী ঘাটে বসে লিখেছিলেন, ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’। দেহি পদপল্লবমুদারম কাহিনীতে রয়েছে, জয়দেব একবার পদ শেষ করতে পারছিলেন না, মম শিরসি মণ্ডনং লিখে পরবর্তী অংশ আর লিখতে পারছিলেন না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারক কি করে রাধার পা ধরবেন? ভাবতে ভাবতে নদীতে স্নান করতে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান সেরে ফিরে এলেন। স্ত্রী পদ্মাবতী বললেন, তাড়াতাড়ি হয়ে গেল? পদ পেয়ে গিয়েছেন জানালেন। খাওয়া শেষ করে তিনি পদ্মাবতীকে পুঁথি আনতে বললেন। পদ্মাবতী পুঁথি নিয়ে এলে তিনি তাতে লিখলেন, দেহি পদপল্লবমুদারম। তারপর তিনি বিশ্রাম করতে ঘরে চলে গেলেন। পদ্মাবতী জয়দেবের পাতে খেতে বসলেন। এমন সময় জয়দেব স্নান সেরে ফিরলেন। জয়দেবকে দেখে পদ্মাবতী অবাক! সব শুনে জয়দেবও অবাক। পুঁথি দেখে জয়দেব বুঝতে পারলেন, ভক্তের ভগবান নিজের হাতে লিখে গিয়েছেন। জয়দেব-কেন্দুলীর রাধাবিনোদ বিগ্রহ বা মন্দিরের সঙ্গে জয়দেবের নাকি কোনও সম্পর্ক নেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, জয়দেব তাঁর বিগ্রহ রাধাবিনোদ বৃন্দাবনে নিয়ে যান। বর্তমান বিগ্রহ ও মন্দির পরবর্তী কালে নির্মিত। কথিত আছে, অজয় নদের অপর পাড়ে, শ্যামরূপার গড়ে যে রাধাবিনোদ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বর্ধমানের রাজপরিবার রাধাবিনোদ বিগ্রহ শ্যামরূপার গড় থেকে এনে কেন্দুলীতে প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি অনুসারে জনৈক বিনোদ নামে এক রাজা শ্যামরূপার গড়ে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর নামানুসারে বিগ্রহের নাম হয় রাধাবিনোদ।
জয়দেব-কেঁদুলির রাধাবিনোদ মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জয়দেবের কোনও যোগ নেই। জয়দেব জীবিত ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত। জয়দেবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে রাধাবিনোদ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কবির জীবৎকালের অন্তত পাঁচশো বছর পর। ভারতীয়
সুকুমার সেন উল্লেখ করেছেন ১৬৯৪ থেকে এখানের ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কীর্তিচন্দ্র জননী ব্রজকিশোরীদেবী মন্দির গড়েন। জয়দেবের স্মৃতিবিজড়িত কেঁদুলি বা কেন্দুলি মেলা এই মন্দিরের উৎসব নয়। রাধাবিনোদ মন্দিরের প্রধান উৎসব হল রথ, দোল, রাস। নিত্য পুজো তো আছেই।