আমাদের প্রাণের শহর কলকাতা নানান ভাষাভাষি ও নানা ধর্মের মানুষের মহামিলনক্ষেত্র। গোটা বাংলাই তাই, অন্য ভাষার মানুষেরা বাংলায় এসে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। মিশে গিয়েছে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে। তেমনই এক মেলবন্ধনের দেখা মেলে কলকাতার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র বড়বাজারে। বড়বাজারে রয়েছে পুঁটেকালী মন্দির। বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালিরাও এই মন্দিরে নিত্য যাতায়াত করেন। নিয়মিত পুজো চলে। মনস্কামনা পূরণের জন্যেই তারা নিয়মিত ভিড় করেন এখানে। অবাঙালিরাও বাঙালিদের মতোই মাথা ঠেকান, প্রার্থনাও করেন।
মন্দিরের প্রতি আকর্ষণের প্রধান কারণ হল স্থানীয়দের বিশ্বাস। মন্দিরের অলৌকিকত্বে মজে সকলে। কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে তারাসুন্দরী পার্কের পাশে তান্ত্রিক মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবীর উচ্চতা মাত্র ছয় ইঞ্চি। নববৃন্দাবন থেকে দেবীর মূর্তি আনা হয়েছিল। ১৫৫৮ নাগাদ, অর্থাৎ আকবরের আমলে এখানে পাকা মন্দির তৈরি হয়।
কথিত আছে, মানিকরামের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে একজন জনৈক খেলারাম একটি যজ্ঞ করছিলেন। সেই সময় গঙ্গার খাদ থেকে একটি পুঁটিমাছ লাফিয়ে যজ্ঞকুণ্ডে পড়ে। খেলারাম অর্ধদগ্ধ মাছটিকে তুলে ফের জলে ফেলে দিতেই তা আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এখানকার দেবীর নাম পুঁটিকালী বা পুঁটেকালী। ব্রিটিশ আমলে মন্দিরটি রাজপথ নির্মাণের জন্য ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু, আদালতের শরণাপন্ন হয়ে মন্দির রক্ষা করেন মন্দিরের সেবায়েতরা। ১৯৩০-এর দশকে এই মন্দির সংস্কার করা হয়। এই মন্দিরের অন্যতম বিশেষত্ব, এর একটি পাতালকক্ষও আছে।
অর্ধ দগ্ধ পুঁটিমাছ যেখানে বেঁচে ওঠে, সেই মন্দিরে যে অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা থাকবে, তা বলাবাহুল্য। অসংখ্য ভক্ত এখানে আসেন, তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। অবাঙালি সম্প্রদায়ের কাছেও এই মন্দির বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছে। মনস্কামনা পূরণের পর ছাগবলিও হয় এখানে। অবাঙালিরা অবশ্য মনস্কামনা পূরণের পর দেবীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করেন। যাবতীয় পুজো চলে তন্ত্রমতে। শ্যামাপুজোর দিন দেবীকে স্বর্ণবেশ পরানো হয়। কালী পুজোর দিনে মন্দিরে ভৈরবী পুজোও হয়। পরদিন কুমারী পুজো ও অন্নকূট উৎসব। এমন মাছ বেঁচে ওঠার গল্প আরও দুই মন্দিরে দেখতে পাওয়া যায়, তারাপীঠের গপ্পো বলি। শোনা যায়, জয়দত্ত নামে এক বণিক বাণিজ্য করতে বেরিয়ে চণ্ডীপুরে পৌঁছে তরী নোঙর করেন। তখন তারাপীঠ ওই নামেই খ্যাত ছিল। বণিকের সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে। হঠাৎই বনিকের ছেলেকে সাপে কামড়ালে, সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। শোকে কাতর বণিক শিবির সেখানেই অবস্থান করতে শুরু করে। তাদেরই একজন লোক জীবিতকুণ্ড পুকুর থেকে একটা শোল মাছ ধরে আনে। মাছ কেটে ওই পুকুরেই ধুতে নিয়ে গেল, ধোয়ার সময়ে কাটা মাছ জোড়া লেগে বেঁচে ওঠে! জয়দত্তর তার লোকদের মরা ছেলেকে নিয়ে পুকুরের জলে ডোবাতে বলে। সেই ছেলে বেঁচে উঠল। সেই থেকে তারাপীঠে শোল মাছ মঙ্গলের প্রতীক হয়ে উঠল। আজও মায়ের ভোগ শোল মাছ ছাড়া অসম্পূর্ণ।
মেদিনীপুর জেলার সদর শহর তমলুকের মা বর্গভীমাকে ঘিরেও তারাপীঠের মতোই এক গল্প প্রচলিত রয়েছে। মনে করা হয়, সতীর বাম পায়ের গোড়ালি এখানে পড়েছিল। কথিত আছে, মহাভারতে উল্লেখিত তমলুকের ময়ূর বংশীয় তাম্রধ্বজ রাজাই নাকি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। জনশ্রুতি রয়েছে, রাজার আদেশে এক দরিদ্র ধীবরপত্নী প্রতিদিন জ্যান্ত শোল মাছ দিতে আসতেন। সারাবছর কীভাবে জ্যান্ত মাছের জোগান দেন ওই ধীবর পত্নী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজা সন্ধান পান দেবীর। ধীবরপত্নী রাজাকে জানান, জঙ্গলে ঘেরা একটি কূপ থেকে জল ছিটিয়েই মরা শোলকে জ্যান্ত করে তিনি নিয়ে আসতেন। ধীবরপত্নীর কথামতো রাজা দেবী বর্গভীমার মূর্তি পান। সেখানেই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা। এখনও এই মন্দিরে মাকে নিবেদন করা হয় শোল মাছের ঝোল। ভক্তরাও মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে শোল মাছ নিয়ে মন্দিরে হাজির হন।