আজ ব্রহ্মময়ী কালীর কথা। বাংলায় অজস্র ব্রহ্মময়ী কালী রয়েছেন, পূজিতা হচ্ছেন। কিন্তু যার কথা আজকের কালী কথায় উঠে আসতে চলেছে তিনি হলেন খাস ভবতারিনীর ভগিনী। বরাহনগরের কুঠিঘাট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির হল ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির। যদিও মন্দিরটি প্রামাণিক কালী বাড়ি নামেই অধিক পরিচিত এবং খ্যাতও বটে। বাংলার ১২৫৯ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৫৩ সালে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। দে-প্রামাণিক পরিবারের দুই সদস্য দুর্গাপ্রসাদ দে প্রামাণিক ও রামগোপাল দে প্রামাণিক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন কাকা ও ভাইপো। দে প্রামাণিকদের আদি বাড়ি ছিল বর্ধমানের পুলিনপুর গ্রামে। সেই পরিবারের কুলপুরোহিত ছিলেন বড়ালরা। তারাই পাঁচ পুরুষ ধরে ব্রহ্মময়ীর পুজো করে চলেছেন। দে প্রামাণিকরা আদপে ব্যবসায়ী পরিবার। এক সময় ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে তারা বর্মায় বসবাস করতেন। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ শুরু হলে, দে প্রামাণিকরা দেশে ফিরে আসেন। তারপরই দে প্রামণিক পরিবারের এক পুরুষ জনৈক কামদেব দে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তখন থেকেই দে প্রামাণিক পরিবারের কলকাতায় স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু। কামদেব দে-এর বংশধরই হলেন রামগোপাল দে ও দুর্গাপ্রসাদ দে, অর্থাৎ ব্রহ্মময়ী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।
মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দক্ষিণা কালী। শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে কয়েকবার এসেছেন। তিনি ব্রহ্মময়ী কালী মাসি বলে ডাকতেন। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে, অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার দু-বছর আগে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রহ্মময়ী মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। আদপে ওই সময় বাংলায় নবরত্ন স্থাপত্যরীতির অজস্র মন্দির তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণেশ্বরও কিন্তু নবরত্ন মন্দির। ব্রহ্মময়ী মন্দির উঁচু ভিত্তিবেদির স্থাপিত। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের সামনে লোহার ফটক, এই ফটক পেরিয়ে ঢুকলে দুপাশে দুটি ছোট শিব মন্দির রয়েছে। আরও একটু এগোলেই চোখে পড়বে দুপাশে আরও দুটি বড় শিব মন্দির রয়েছে। শিব মন্দিরগুলি বাংলার আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। প্রতিটি শিব মন্দিরে বিরাজ করছেন প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি তুলসীমঞ্চ।
মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকার বিগ্রহ কষ্টিপাথরে তৈরি। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত দাঁইহাটের বিখ্যাত নবীন ভাস্কর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তিনি তিনটি মায়ের মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। প্রথম মূর্তিটি শিবচন্দ্র গোহ ১২৫৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৫০ সালে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে তাঁদের পৈতৃক বাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ ১১, বৃন্দাবন বসু লেন। এই বিগ্রহের নাম 'নিস্তারিণী'। দ্বিতীয় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয় দে-প্রামাণিক কালী বাড়িতে। তৃতীয় মূর্তিটি হলেন মা ভবতারিনী। যিনি দক্ষিণেশ্বরে বিরাজ করছেন।
মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। এছাড়াও প্রত্যেক মাঘী পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠাতিথিতে বিশেষ পুজো হয়। দীপাবলীতে অর্থাৎ কার্তিক অমাবস্যায় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। মহাধুমধাম করে পুজো হয়। মন্দিরের একটি প্রথা রয়েছে। কালী পুজোর দিন অমাবস্যা তিথি পড়ার পর দে-প্রামাণিকদের কোন শরিকের বাড়িতে সবার আগে লক্ষ্মী পুজো করা হয়, তারপর মা ব্রহ্মাময়ী মন্দিরে কালী পুজো শুরু হয়। অর্থাৎ কালী পুজো রাতে মা ব্রহ্মময়ীর পুজোর আগে লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। এককালে পশু বলি হলেও, কালের নিয়মে মন্দিরে এখন পশুবলি হয় না। বর্তমানে মন্দিরটি শ্রীশ্রীব্রহ্মময়ী ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত। মন্দিরের প্রবেশপথে একটি শ্বেতপাথরের ফলক চোখে পড়ে। তাতে লেখা-
"মোহন মূরতি মার যেন গো বালিকা।
ব্রহ্মময়ী নামে খ্যাত হইলা কালিকা।।
রাসমণির মা কালী, এই কালী মাতা।
এক ব্যক্তি উভয়ের আছিলা নির্মাতা।।
সুমিষ্ট মা, মাসী নাম দিলা সে কারণে।
প্রভু রামকৃষ্ণ ইহা শুনেছি শ্রবণে।।
নির্মাতা ও প্রতিষ্ঠাতা মহা ভাগ্যবান।
যাঁহাদের কীর্তি হেরি তুষ্ট ভগবান।। "
বরাহনগরের প্রামাণিক ঘাট রোডের উপর এই মন্দির অবস্থিত। রামকৃষ্ণ কথামৃত অনুযায়ী, দে-প্রামাণিক বংশীয়দের প্রাচীন কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন। বইতে রয়েছে, "ভবতারিণী মূর্তির সহিত ইহার সম্বন্ধ পাতাইয়া এই মূর্তি 'মাসিমা' বলিয়া পরিচিত।" ভবতারিণী, কৃপাময়ী আর ব্রহ্মময়ী হলেন আসলে মা কালীর তিন রূপ। ভবতারিণী হলেন দক্ষিণেশ্বরের কালী, কৃপাময়ী হলেন বরাহনগরের জয় নারায়ণ মিত্রর বাড়ির কালী এবং ব্রহ্মময়ী হলেন কাশীপুরের প্রামাণিক ঘাট রোডের কালী। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একই কষ্টি পাথর থেকে তৈরি হয়েছিল ভবতারিণী, কৃপাময়ী আর ব্রহ্মময়ীর বিগ্রহ। মূর্তির কারিগরও নাকি একই মানুষ। সর্বপ্রথম তৈরি হয় জয় মিত্র কৃপাময়ীর মূর্তি। এরপর তৈরি হয় ব্রহ্মময়ী ও মা ভবতারিণীর বিগ্রহ। এক্ষেত্রে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময়কালের ভিত্তিতে বড় বোন-ছোট বোন নির্ধারিত হয়নি, বিগ্রহের উচ্চতার ভিত্তিতে বড় বোন-ছোট বোন ঠিক হয়েছে। তিনটি মাতৃ মূর্তির উচ্চতা অনুযায়ী ভবতারিণীর মূর্তিই সবথেকে বড়। তাই সে বড় বোন। মেজ ও ছোট হলেন মা কৃপাময়ী ও মা ব্রহ্মময়ী। এই তিন দেবী মূর্তির নামকরণও করেন একই মানুষ। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। ১৮৪৮ সালে বরাহনগরের জমিদার জয়নারায়ণ মিত্র তৈরি করেন কালীমন্দির। মন্দিরে ছিল ১২ টি শিব মন্দির ও একটি বড় কালীমন্দির। শোনা যায়, এই মন্দির দেখেই নাকি রানি রাসমনী দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ তার তিন বছর পর ১৮৫৩ সালে মাঘী পূর্ণিমায় তৈরি হয়েছিল ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির৷ ব্রহ্মময়ী তিন বোনের তুলনায় উচ্চতায় খাটো।
ব্রহ্মময়ী কালী মূর্তিটি আদপে দক্ষিণা কালীর মূর্তি। কৃপাময়ী কালী মন্দিরের মতো ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরেও শ্রীরামকৃষ্ণের যাতায়াত ছিল। কৃপাময়ী কালীমূর্তির মত ব্রহ্মময়ী কালীমূর্তিও কষ্টিপাথরের। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার দাঁইহাটের নবীন ভাস্করের হাতে গড়া মূর্তি। এই নবীন ভাস্করই উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের বাসিন্দা শিবচন্দ্র গোহর ১১, বৃন্দাবন বসু লেনের বাড়িতে ১৮৫০ সালে দেবী নিস্তারিণীর বিগ্রহ তৈরি করেছিলেন। ওই বছরই তৈরি করেছিলেন বরানগর কুঠিঘাটের কৃপাময়ী কালীমূর্তি। তার বছর দুয়েক বাদে কুঠিঘাটের আরেক মন্দিরের জন্য তৈরি করেছিলেন ব্রহ্মময়ী কালীমূর্তি। তারও বছর দুয়েক বাদে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের জন্য তৈরি করেছিলেন ভবতারিণীর মূর্তি। ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরে যেতে হলে সিঁথির মোড় থেকে কুঠিঘাটগামী অটোয় উঠতে হবে। কুঠিঘাটে নামার পর কাছেই ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরের দেখা মিলবে। বরাহনগর ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ। এখানে হাজারও মন্দির রয়েছে। বরাহনগরকে মন্দিরের সাম্রাজ্য বললে খুব ভুল কিছু বলা হয় না।