আজ আচারের দিন। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ আচার। আমেরিকায় সেই ২০০১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর দিনটিকে আচারের দিবস বা Pickle Day হিসেবে পালন করা হয়। এদিন একে অন্যকে উপহার হিসেবে আচার পাঠায়। আমেরিকার আবিষ্কারের কৃতিত্ব ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের পর যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তিনি হলেন আচার! কলম্বাসের পর নয় বরং তাঁর থেকেও কিছুটা বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য আচারের, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানে কলম্বাস তাঁর নাবিকদের প্রতিদিন রেশন হিসেবে আচার দিতেন। এই আচারই তাদের ভিটামিন সি-এর অভাব মিটিয়ে স্কার্ভি রোগের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। তাই তারা সংক্রমণজনিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পায় এবং অভিযানও সফল হয়।
আচার বানানো একটা প্রাচীন প্রযুক্তি, যখন ফ্রিজ ছিল না, ড্রাইয়ার ছিল না, হিমঘরও ছিল না, তখন ফল বা সবজিকে এমনভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হত। আচার প্রচলিত ছিল বণিক অথবা যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে, যারা দূর দূরান্তে পাড়ি দেন। ইতিহাসবিদদের মতে, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম খাবার আচার, যার বয়স সাড়ে চার হাজার বছরেরও বেশি। ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সময় থেকে মানুষ আচার খাওয়া শুরু করে। পৃথিবীর প্রাচীনতম আচারের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শসার তৈরি আচারের কথা। মনে করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২০৩০ সন মেসোপটেমিয়ায় শসার আচারের প্রচলন ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রানি ক্লিওপেট্রা নিয়মিত আচার খেতেন তাঁর সৌন্দর্য অক্ষত রাখার জন্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জিনিসের আচার তৈরি করা হয়। শুধু ফল কিংবাংবা সব্জি নয়। বিভিন্ন ধরণের মাংস, মাছ এবং ডিমেরও আচার তৈরি করা হয়, মূল উদ্দেশ্য এগুলোকে দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করে রাখা। কোনও কোনও দেশে মাংসেরও আচার তৈরি করা হয়। আমাদের দেশেও হয়। চীনে ডিমের আচার, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতে হাঙ্গরের মাংস দীর্ঘদিন পরে খাওয়া হয় মূলত আচার বানিয়ে। আচার তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুল্ম গুলফা, যা প্রথম ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা থেকে পশ্চিম ইউরোপে আসে নবম শতকে। ১৬৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শসা থেকে আচার তৈরি করে ব্যারেলে করে বিক্রি করা হত দেশে-বিদেশে।
বাংলার সাথে আচারের সম্পর্ক অতি নিবিড়, তবে আজকের বেঙ্গলী খালি খাওয়া বাঙালি তার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবে না। ভারতের উত্তর পশ্চিমের রাজ্যগুলি আচার বানাতে খুবই পটু, বিশেষ করে রাজস্থান এবং গুজরাত; আচার বানাতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমভারতের নাম। সুলতানি আমলে মানসিংহের হাত ধরে বাংলায় প্রবেশ ঘটে আচারের। আগে বাঙালি আচার তৈরির পদ্ধতি ও স্বাদ জানত না। বিভিন্ন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ থাকলেও আচারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পশ্চিমভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় রাজস্থান পাঞ্জাবের মানুষের আনাগনা হয়। তাদের সংস্কৃতিতে আচারের প্রচলন আছে। কারণ মরুভূমি অঞ্চলে সেইভাবে চাষবাস হয় না। আচারের মাধ্যমে নানাধরনের সবজিকে সংরক্ষণ করা হয়। মাছে-ভাতে বাঙালির কিন্তু নিজের আচার হল তেল আচার, রোদে সানবাথ খাওয়ানো। আজ ছাদে বোয়ামে রাখা আচার আর তা চুরি করে খাওয়া বাঙালির স্মৃতি হয়ে গিয়েছে, বই আর সিনেমায় কেবল স্থান পেয়েছে। বাংলায় আচার হয় টক, মিষ্টি, ঝাল, টক-ঝাল-মিষ্টি। লেবু, আমড়া, জলপাই, আমলকি, তেঁতুল, কুল, চালতা, আনারস, কামরাঙ্গার মত টক জাতীয় ফল ছাড়া ও বিভিন্ন ধরনের সব্জি যেমন গাজর, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, মূলো, টমেট, বরবটি, ইঁচড় দিয়েও আচার করা হয়।
আচার খেতে ভালবাসেন না, এরকম মানুষ পাওয়া মুশকিল। রুটি-পরোটার সঙ্গে আচারের একটু স্বাদ অন্য মাত্রা এনে দেয়। আবার আচার দিয়ে যদি মুড়ি মাখেন, তার স্বাদেও কিন্তু জিভে জল আসতে বাধ্য। আচার বানানোয় ঠাকুমা-দিদিমারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মোটামুটি সব বাড়িতেই খোঁজ করলে লঙ্কার আচার, আমের আচার, তেঁতুলের আচার, একটা না একটা মিলতই। আচারের অপূর্ব স্বাদ!
আসলে শেষপাতে অম্ল না হলে খাওয়া নাকি ঠিকঠাক হয় না। ফলের মরশুমের শুরুতেই মা-ঠাকুমারা ফল কেটে রোদে শুকিয়ে তেল মশলা দিয়ে তুলে রাখে সারা বছর খাওয়ার জন্য। যে মরশুমে যে চাষ, সেই অনুযায়ী আচার দেওয়া। আচারের উপাদানকে প্রথমে রোদে কিছুদিন শুকিয়ে নিতে হয় যাতে এর মধ্যেকার জল না থাকে। মা ঠাকুমাদের ব্যাঙ্ক ছিল ভাঁড়ারঘর, সেখানেই রাখা হত আচার। রবি ঠাকুরেরও খুব প্রিয় ছিল বিভিন্ন ধরণের আচার। তবে আমের আচার ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।