আজকের কালীকথায় পানিহাটির এক কালী মন্দিরের কথা, মন্দিরটি মা সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির নামে পরিচিত। পেনেটি, পুণ্যহট্ট থেকে আজকের পানিহাটি, এই জনপদের ইতিহাস পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। চৈতন্যদেব তথা বৈষ্ণব স্মৃতি বিজোড়িত এই অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মন্দির, রয়েছে একাধিক কালীক্ষেত্রও। সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম, সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের হাতেই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, "এঁরা দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরী। এঁদের প্রতাপে সেকালে বাঘে-গরুতে একসঙ্গে জল খেত। এঁরা লোকের জাত দিতে নিতে পারতেন তবে ভক্তিমানও ছিলেন খুবই, এই বাড়িতে কত যেতুম, ভাগবত পুরাণপাঠ শুনতুম…।”
বড়িশা, উত্তর ২৪ পরগণার হালিশহর, নিমতা, বিরাটি, হুগলির উত্তরপাড়া, মেদিনীপুরের খেপুতের মতো পানিহাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার। পানিহাটিতে রাধাগোবিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের গৌরীচরণ রায় চৌধুরী। তাঁর পুত্র জয়গোপাল রায় চৌধুরী রাধাগোবিন্দ মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, সদাশিব মন্দির, রাসমঞ্চ এবং চারটি প্রচীন আটচালা শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রায় চৌধুরীদের শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দজী অবস্থান করছেন পানিহাটি বাজারপাড়া সংলগ্ন কাছারী বাড়ির দোতলায়।
সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা বাংলার ঐতিহাসিক জমিদার পরিবার। কলকাতার শ্রেষ্ঠ কালীক্ষেত্র কালীঘাট এদের হাতেই তৈরি। ১৬১০ সালে সাবর্ণ পরিবারের লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী বড়িশায় প্রথম আটচালার দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির সত্ত্ব সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে ইজারা নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এদেরই মা সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, পানিহাটির অন্যতম কালীক্ষেত্র।
১৯৪৯ সালের শনিবারের চিঠি পত্রিকা থেকে জানা যায়, 'এই রাধাগোবিন্দজীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন লর্ড ক্লাইভের সময় এই জমিদারদের আদিপুরুষ নাটোরের রানী ভবানীর দেওয়ান শ্রী গৌরীচরণ রায় চৌধুরী। দেওয়ান গৌরীচরণের পানিহাটী-দুর্গাপুর জমিদারী তৎকালে কিরূপ বিশাল ছিল দেওয়া তাহার একটি ইঙ্গিত সরকারী গেজেটে পাওয়া যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ সাল) পরে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পরেই পানিহাটীর বাবুরা সর্বাপেক্ষা বেশি রাজস্ব দিতেন। তাঁহার পুত্র জয়গোপাল রায় চৌধুরী কাশীতে গিয়ে বহু দান-ধ্যান করেন ও সাধু-সন্ন্যাসী ভোজন করান। দেশে ফিরিয়া তিনি বহু দান, মন্দির প্রতিষ্ঠা, রাস্তা, ঘাট প্রতিষ্ঠা, ব্রহ্মোত্তর দান, জলাশয় প্রতিষ্ঠা করেন।'
এই গৌরীচরণ রায় চৌধুরী সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেও, মন্দির গড়ে দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র শ্ৰী জয়গোপাল রায় চৌধুরী। এই মন্দিরের মা সিদ্ধেশ্বরী দ্বিভূজা। এই মন্দিরের দেবী কালিকা অর্থাৎ সিদ্ধেশ্বরী কালী পদ্মাসনে বসা, দুই হাতের বিগ্রহ। দেবীর পদতলে প্রথমে শিব ছিলেন না, পরবর্তীকালে চৌধুরী বংশের কোনও এক পুরুষ স্নান করতে গিয়ে একটি শিব লিঙ্গ পেয়েছিলেন। সেটিই ছিল সদাশিব, যা আজও মায়ের মন্দিরে বিদ্যমান, মাতৃ মূর্তির ঠিক পাশেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সদাশিব। মন্দিরে কালীপুজোর দিন বিপুল ভক্ত সমাগন হয়। প্রথা মেনে নিশিরাতেই মায়ের পুজো হয়। মন্দিরে ফলবলির প্রথা রয়েছে। মায়ের জন্য ভোগ হিসেবে এখানে খিচুড়ি, সাদাভাত, পোলাও, সাত রকমের ভাজা, নানান তরকারি, পায়েস নিবেদন করা হয়।
উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটি ফেরিঘাট অঞ্চলে এই সাবর্ণ পরিবারের দু'টি কালীমন্দির রয়েছে। দুটিই সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির। এর মধ্যে একটি মন্দিরে মা কালী চতুর্ভূজা এবং অন্যটিতে দু'হাতের দেবী কালিকা বিরাজমান। চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরটি উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটি সুখচরে অবস্থিত। কথিত আছে, প্রতাপাদিত্যের মা স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে এক সাধকের তপস্যায় এই মন্দিরের দেবী কালিকা সিদ্ধেশ্বরী নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলার ১৩০৯ সন নাগাদ, বর্ধমানের দাঁইহাট থেকে শিল্পী নিয়ে এসে কষ্টিপাথর দিয়ে মন্দিরের বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এই সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। এই মন্দিরের বয়স আনুমানিক চারশো বছরেরও বেশি। মহাড়ম্বরে মন্দিরে কালী পুজো হয়, এখানে কালী পুজোর দিন ছাগ ও সুপারি বলি প্রথা আজও চালু আছে। দীপান্বিতা কালী পুজোর পরদিন হয় অন্নকূট। পাহাড় প্রমাণ অন্ন, খিচুড়ি, পনির, ফুলকপি, পায়েস, মালপোয়া সহ বিভিন্ন পদ সাজিয়ে দেবীর ভোগ নিবেদন করা হয়। ভক্তদের জন্য প্রতিবছর থাকে বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা। ভক্তদের মতে, এই মন্দিরের মা কালী খুবই জাগ্রত।