কালী কথা: পাণ্ডাপাড়া ভদ্রকালী মন্দির, চরণ তলে সাপরূপী সৃষ্টি ও প্রলয়কে ধরেছেন যিনি

আগের পর্বে খাস কলকাতার কালী ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলেছিলাম। এবার শহর ছেড়ে উত্তরের দিকে যাব। আসলে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে, সেই কারণে কলকাতায় বেশিদিন বন্দি থেকে লাভ নেই। আজ জানবো উত্তরবঙ্গের পাণ্ডাপাড়ার ভদ্রকালী মন্দিরের কথা। কথিত আছে, ১৬৯৩ সালে কোচবিহারের রাজা রূপনারায়ণ এই ভদ্রকালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অন্য একদল গবেষকের মতে, বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেব এই ভদ্রকালী মন্দিরের দেবী কালিকার বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। দেবী মূর্তি এখানে আজও মৃন্ময়ী, অর্থাৎ মাটির তৈরি। এই মন্দিরের মাতৃ মূর্তির বিশেষত্ব হল এখানে দেবী পদতলে শিব বিরাজ করেন না। শিবের বদলে দেবীর পদতলে থাকে সাপ। দেবী ভদ্রকালী এখানে লোলজিহ্বা নন। এটাও এখানকার বৈশিষ্ট বলা যেতে পারে। 

যাকে নিয়ে এতো কথা সেই ভদ্রকালী আদপে কে?

মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুরমর্দিনী, চণ্ডী ও মন্দিরের; তিনজনেই এক এবং অভিন্না। মহাভারত অনুযায়ী, ভদ্রকালী হলেন দেবী দুর্গারই আরেক রূপ। কালিকাপুরাণ ও দেবীপুরাণ অনুসারেও, ভদ্রকালীই দুর্গা। কালিকাপুরাণ অনুযায়ী, ভদ্রকালীর মূর্তি ষোড়শভুজা, অতসীপুষ্পবর্ণা, মস্তকে জটাজুট ও চন্দ্রকলা শোভিতা, কণ্ঠদেশে নাগহার ও স্বর্ণহার পরিহিতা, দক্ষিণ হস্তসমূহে শূল, চক্র, খড়্গ, শঙ্খ, বাণ, শক্তি, বজ্র, দণ্ড এবং বাম হস্তসমূহে খেটক, ঢাল, ধনু, পাশ, অঙ্কুশ, ঘণ্টা, পরশু ও মুষল ধারিণী। সিংহপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান অবস্থায় বামপদে মহিষাসুরকে আক্রমণ করে তিনি তাকে শূলের দ্বারা বিদ্ধ করেছেন। একেবারেই যেন মা দুগ্গা। কোথাও কোথাও আবার দেবী সরস্বতীকেও  ভদ্রকালী নামে অভিহিত করা হয়। ভদ্রকালীর মধ্যেও তিন রূপভেদ স্পষ্ট। ভদ্রকালী কখনও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, কখনও দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী ও ভয়ংকরী চামুণ্ডারূপিণী।

উত্তরবঙ্গে রয়েছে পাণ্ডাপাড়া, স্টেশন থেকে দূরত্ব কিলোমিটার দুয়েক। জলপাইগুড়িতে নেমে বাসে মিনিট দশেকের পথ এই পাণ্ডাপাড়া। এখানেই রয়েছে ভদ্রকালী মন্দির। রাস্তার উপরেই অবস্থিত দেবী মন্দির। প্রচলিত ইতিহাস অনুসারে, কোচবিহারের রাজা রূপনারায়ণ ১৬৯৩ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে দ্বিমত আছে। কথিত আছে, বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেবের রাজত্বকালে ১৭৫৮-৯৩ সালের মধ্যে এই পুজো শুরু হয়। অন্য মতে, কোচবিহারের রাজা রূপনারায়ণ এ পুজোর প্রচলন করেন ১৬৯৩ সাল নাগাদ। বৈকুণ্ঠ রাজ শ্রী দর্পদেবকে দেবী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা বলছেন কেউ কেউ। এই মৃন্ময়ী কালীমূর্তির চরণতলেস্থান রয়েছে সর্প। মৃন্ময়ী মূর্তিটি একটি নাগ ও নাগিনীর লেজের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দেবীর দুই হাতে দুটি সাপ ধরা। এই মূর্তির সঙ্গে পরিচিত কালীমূর্তির কোনও মিল নেই। এখানে প্রতিমার জিহ্বা অদৃশ্য, তিনি লোলজ্বিহা নন, প্রসন্নময়ী। ঠোঁটের পাশ বেয়ে নেমেছে রক্তের ধারা। মূর্তির এক পাশে ডাকিনী ও অন্য পাশে যোগিনী দণ্ডায়মান। মূর্তির উচ্চতা প্রায় চার ফুট। দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে মা ভদ্রকালী এখানে নিত্য পূজিতা হন। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় এখানে কালীপুজো করা হয়। কালীপুজোয় ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে। মন্দির প্রাঙ্গনে বসে মেলা। 

জনসাধারণের বিশ্বাস দেবী খুব জাগ্রত। ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে পূজিত হচ্ছেন দেবী। দেবী মূর্তির রূপ অগ্নি পুরাণ থেকে নেওয়া হয়েছে। চিরাচরিত দক্ষিণা কালীর প্রতিমার মতো এই মূর্তির অবয়ব নয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৭১৫ সালে বৈকুণ্ঠপুরের রাজ পরিবারের সিংহাসনে বসেন দর্পদেব রায়কত। তিনি পুরী থেকে পান্ডা নিয়ে এসে এই পুজো আরম্ভ করেন। যদিও মন্দির অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল। ধাপে ধাপে এই ভদ্রকালী মন্দিরটি ঘিরে পাণ্ডাদের বসতি গড়ে ওঠে। বংশপরম্পরায় তাঁরাই ভদ্রকালীর পূজারি। সেই থেকেই এলাকার নাম হয়ে গিয়েছে পাণ্ডাপাড়া। আজও রাজ পরিবারেরই সদস্যরাই মন্দিরের দায়িত্বে রয়েছেন।

এই সাপ দুটি গোখরো সাপ। কারও কারও মতে, এই সাপ দু'টি সৃষ্টি ও প্রলয়ের প্রতীক। দেবী এখানে দু'টি সাপকে গিলে খাচ্ছেন, অর্থাৎ একই সঙ্গে সৃষ্টি ও প্রলয়কে ধারণকরে দেবী জনসাধারণের মঙ্গল কামনা করছেন। এখানে প্রতিমার জিভ নেই, মায়ের মুখ থেকে রক্তের ধারা নেমে এসেছে। বলা হয় এই দেবীর রূপ হল চণ্ডীরূপী মনসা, মহাদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে রণরঙ্গিনী ধ্বংসকারিণী মূর্তি।

উত্তরবঙ্গের কালীক্ষেত্র গুলো নিয়ে বিচিত্র গল্পের অন্ত নেই। শিলিগুড়িতে রয়েছে সেবকেশ্বরী কালীমন্দির। শিলিগুড়ির কালীবাড়ি রোডে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত আনন্দময়ী কালীবাড়ি। ১৯১৫ সালে জনৈক চন্দ্রমোহন চক্রবর্তী এখানে নিত্য পুজোর প্রচলন করেন। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, স্বদেশীরাও। এখানেই ছিল তাঁদের শরীরচর্চার আখড়া। ১৯২৩-২৪ সাল নাগাদ মুকুন্দদাস মন্দিরের চালা ঘরেই রাতের পর রাত গান গেয়েছিলেন। শর্ত ছিল, পালা পিছু গান করে পাওয়া ৫১ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা তিনি মন্দির নির্মাণে দান করবেন। সেই সংগৃহীত অর্থে ১৯২৬ সালে তৈরি হয় মন্দির। কবি মুকুন্দ দাসই কালীবাড়িটির নামকরণ করেন আনন্দময়ী কালী। বেনারস থেকে কষ্টিপাথরের মূর্তিটি নিয়ে আসা হয়েছিল। কালিম্পঙের অষ্টমাইল এলাকার কালীমন্দিরটি  ঢাকায় কমলা কালীবাড়ির জমিদারদের সেজ ছেলে স্বামী জ্ঞানানন্দ তীর্থনাথ প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। দেশভাগের আগেই তিনি কালিম্পঙে এসেছিলেন। জয়পুর থেকে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের কালী মূর্তিটি এনেছিলেন। ভারত-চিন যুদ্ধে দরুণ কালিম্পঙে মূর্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি সে'সময়। বীরভূমের সুরুলে তিনি মূর্তি স্থাপনের উদ্যোগ নেন। শোনা যায়, সেখানে নাকি কোনোভাবেই কেউ মূর্তির বাক্সটি খুলতে পারেননি। অগত্যা কালিম্পঙেই ফিরে আসেন দেবী মূর্তিটি। প্রতিষ্ঠিত হন। প্রথমে মন্দিরটি ছিল কাঠের। এখন পাকা মন্দির প্রাঙ্গণে হয়েছে। কালীপুজোর রাতে সোনা ও রুপোর অলংকারে সেজে ওঠেন মা। স্থানীয় লেপচা, ভুটিয়া, ও নেপালি মানুষরাও এই পুজোতে শামিল হন।

ছবিঃ প্রতীকী

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...