কালী কথা: বেহিরা নিম্ববাসিনী কালীপীঠ, দুর্গা ত্রয়োদশীতে পূজিতা হন দেবী কালিকা

কালী পীঠ বীরভূমে রয়েছে বেহিরা নিম্ববাসিনী কালীপীঠ, আজকের কালীকথায় উঠে আসবে এই মন্দিরের কথা। বীরভূমের পুরন্দরপুর পঞ্চায়েতের বেহিরা গ্রামে কাশীর মা অন্নপূর্ণা বেহিরা নিম্ববাসিনী কালী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রতিবছর দুর্গাপুজোর ত্রয়োদশীতে মহাধুমধাম করে বেহিরা কালীতলায় নিম্ববাসিনী মায়ের পুজো হয়। নিম্ববাসিনী মায়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার মা দুর্গা পুজোর সময় দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কালী এবং অন্যান্য রূপেও পূজিতা হন। বছরের পর বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। ত্রয়োদশীতে এখানে মেলা বসে।

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দ্বাপরযুগে অষ্টাবক্র মুনি দেবী অন্নপূর্ণাকে সতীপীঠ বক্রেশ্বরে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে নদীপথে নৌকা করে কাশী থেকে নিয়ে আসছিলেন। সেই সময়, পুরন্দরপুরের বেহিরা গ্রামের কাছে এসে দেবীর নৌকা ক্ষিণতোয়া বক্রেশ্বর নদীতে আটকে যায়। সেখানে তপস্যা করছিলেন ভরদ্বাজ মুনি। কথিত আছে, ভরদ্বাজ মুনির আহ্বানে দেবী অন্নপূর্ণা কালী রূপে একটি নিমগাছের তলায় বসে যান। তিনি সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হলেন, নাম হল নিম্নবাসিনী কালী। কালী মায়ের নিত্যসেবা শুরু করলেন ভরদ্বাজ মুনি। আজ সেখানেই তৈরি হয়েছে মন্দির। ভরদ্বাজ মুনির স্মৃতিধন্য তপভূমিতেই যুগ যুগ ধরে পূজিতা হচ্ছে দেবী। বেহিরা নিম্ববাসিনী কালীপীঠে যেতে হলে বোলপুর থেকে সড়কপথে সিউড়িগামী বাসে পুরন্দরপুর হয়ে মন্দিরে পৌঁছতে হয়।

একদা এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে ঘেরা। আজও মন্দিরের চারদিক গাছগাছালি ঘেরা। মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে অতিকায় বাঁধানো যজ্ঞমণ্ডপ। সেখানেই রয়েছে ভরদ্বাজ মুনির মন্দির, পাশে অষ্টাবক্র মুনির মন্দির। স্থাপত্যরীতিতে বাংলার চারচালা শৈলী দেখা যায়। উভয় মন্দিরেই রয়েছে শিবলিঙ্গ। প্রাচীন নিমগাছের তলায় নিম্ববাসিনী নামে রয়েছেন দেবী অন্নপূর্ণা। নিম্ববাসিনী মন্দির একচূড়া বিশিষ্ট। মন্দিরের একমাত্র কক্ষটিই গর্ভগৃহ। সেখানেই দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। দেবীর অবস্থানটিও আর পাঁচটা মন্দিরের মতো নয়। অন্যান্য মন্দিরে দেবদেবী মন্দিরের মাঝে অবস্থান করেন। এই মন্দিরের একটি কোণায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে দেবীবিগ্রহ। প্রস্তর বেদীর উপরে পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবীমূর্তির কোমর পর্যন্ত দৃশ্যমান। দেবী মূর্তির উচ্চতা প্রায় চার ফুট, মৃন্ময়ী মূর্তি। মৃন্ময় মূর্তিটি নির্মাণ করেছেন স্থানীয় শিল্পী পীযূষ মণ্ডল। মায়ের প্রশান্ত মুখমণ্ডল, বিস্তৃত ত্রিনেত্র, আকর্ণ। নাকে নথ। মাথায় রয়েছে সুবিশাল রুপোর মুকুট। কারুকার্যখচিত মুকুটটি নির্মাণ করেছেন বাঁকুড়ার শিল্পীরা। উপরের বাম হাতে খাঁড়া, নিচের বাম হাতে ছিন্নমস্তক। দেবীর পরনে বেনারসী।

দেবীর সঙ্গে কোনও শিব নেই। তবে দেবী মূর্তির পাশে স্থাপিত রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। শোনা যায়, কাশিতে বাবা বিশ্বনাথকে একা রেখে দেবী এসেছিলেন বলে, দেবী মূর্তির সঙ্গে মহাদেব নেই।মন্দিরের নিত্য সেবক দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত সদানন্দ ব্রহ্মচারীজি। বীরভূমের ইলামবাজার নিবাসী মুখোপাধ্যায় পরিবার বংশানুক্রমে দেবী নিম্ববাসিনী কালীর সেবাইত। দেবী তাঁদের কুলদেবীও বটে।

দেবী এখানে নিত্য পূজিতা। পঞ্চব্যঞ্জনে দেবীর নিত্যভোগ হয়। ডাল, ভাত, ভাজা, শাকসবজি এবং মাছ থাকে ভোগে। কেউ পাঁঠা বলি তাও দেবীকে নিবেদন করা হয়। মন্দিরে বলিদানের চল রয়েছে। মন্দিরের সামনেই রয়েছে হাড়িকাঠ। মায়ের মন্দিরের পিছনে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সেই নিমগাছটি, কালের নিয়মে প্রায় ভেঙে পড়েছে। গাছটি যে কত কালের প্রাচীন তা বোঝার সাধ্য নেই। এছাড়াও রয়েছে বেশকিছু সমাধিস্থল, মন্দির সংলগ্ন একটি আশ্রম, পিছনে ভোগের ঘর এবং ডোবা। বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গণের আশপাশে কোনও লোকালয় নেই, নির্জন পরিবেশ।

অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের জনক ঋষি ভরদ্বাজের স্মৃতিধন্য এই মন্দরে অতীতে অনেক মুনিঋষি তপস্যা করতে এসেছেন, আজও অনেকে তপস্যা করতে এবং যজ্ঞের উদ্দেশ্যে আসেন। মন্দিরের পিছনের অংশে বড় বড় গাছের ছায়াতলে অতীতে এক সময় এখানে যাঁরা থেকেছেন, সাধনা করেছেন, তাঁদের অনেকের ছোট ছোট সমাধিমন্দির রয়েছে। তবে প্রতি বছর দুর্গা ত্রয়োদশী তিথিতে এখানে দেবীর বিরাট উৎসব হয়। বিপুল জনসমাগম হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...