কালী কথা: নিমতলার আনন্দময়ী কালীবাড়ি

আজ কালী কথায় আনন্দময়ী কালীর কথা। তিনি বিরাজ করছেন খাস কলকাতার বুকে নিমতলা মহাশ্মশানে। গঙ্গার তীরেই মন্দিরটি অবস্থিত। নিমতলা মহাশ্মশানে দাহকার্যের জন্য আনা শবগুলিকে শবদেহ বহনকারীরা এই মন্দিরের সামনে নামিয়ে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে শান্তি প্রার্থনা করে। এটিই কার্যত রীতি হয়ে গিয়েছে। নিমতলাঘাট মহাশ্মশানে যাওয়ার পথে শ্মশান থেকে একটু আগেই ডানপাশে লাল রঙের আনন্দময়ী কালী মন্দিরের দেখা মেলে। আনন্দময়ী কালীবাড়ি, নিমতলা ঘাট স্ট্রিট, জোড়বাগান কলকাতা। স্ট্যান্ড রোড ও নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের সংযোগ স্থলে, নিমতলা ঘাট স্ট্রিটেই রয়েছে মন্দিরটি।        

একদা এই মন্দির ছুঁয়েই গঙ্গা প্রবাহিত হত। নদী অনেকেটাই সরে গিয়েছে উঠে এসেছে স্ট্যান্ড রোড।

ভাগীরথীর তীরে সে সময় থেকেই শ্মশান ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, কোনও এক কালীসাধক শ্মশানের ধারে একটি ছোট কুটিরে কালী পুজো করতেন। সেই কুটিরেই তিনি আনন্দময়ী কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেই কুটিরের জায়গায় মন্দির নির্মিত হয়।

সেই সাধক মৃত্যুর আগে জনৈক জগন্নাথ নামে এক ভক্তকে পুজোর ভার দিয়েছিলেন। জগন্নাথ অবস্থাপন্ন না হওয়ায়, নারায়ণ মিশ্র নামে এক ব্রাহ্মণের কাছে মন্দিরটি বিক্রি করে দেন। নারায়ণ মিশ্রের বড়ো ছেলের মৃত্যুর পর, তাঁর দৌহিত্র জমিদার মাধবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মন্দিরের সত্ত্বাধিকারী হন। তিনিই কুটিরের পরিবর্তে স্থায়ী মন্দির নির্মাণ করান। কিন্তু মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।মন্দিরটি মাঝারি আকৃতির, দোতলা চাঁদনি স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। মন্দিরের চূড়া নেই। মন্দিরের গায়ে সুন্দর কারুকার্য দেখা যায়। মন্দিরের কাছেই একটি পুরনো আটচালা শৈলীর শিব মন্দির আছে। সেই মন্দিরে বড় শিবলিঙ্গ রয়েছে। শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে সেখানে পুজো হয়।

গর্ভমন্দিরে অপূর্ব সাজে সজ্জিতা দেবী আনন্দময়ী বিরাজমানা। সুবসনা, মাথায় স্বর্ণমুকুট। জিহবাটিও সোনার। মাতৃমূর্তি কষ্টিপাথরের সালঙ্করা, পট্টবস্ত্রপরিহিতা। পঞ্চমুণ্ডের আসনের উপর স্থাপিত রূপোর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেবী মূর্তির উচ্চতা দু-ফুটের কাছাকাছি। মন্দিরের আদি কালীবিগ্রহটি ছিল শ্মশানকালীর বিগ্রহ। সেটি ছিল মাটির মূর্তি। বর্তমান মূর্তিটি দক্ষিণাকালীর। প্রতিবছর বুদ্ধপূর্ণিমায় পুষ্পদোল উৎসবের আগে দেবী মূর্তির অঙ্গরাগ করা হয়।

আনন্দময়ী কালীমন্দিরে মার্বেল ফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে।

"শ্রী শ্রী ওঁ আনন্দময়ী জয়তি

       স্বত্বাধিকারী

 শ্রীযুক্ত ননীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

       জমিদার

  ৬৫ নিমতলা ঘাট স্ট্রিট

        কলকাতা"

মন্দির কীভাবে বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাতে এসে পড়ল? শোনা যায়, নারায়ণ বাবু শাক্ত ছিলেন। তিনি দেবীর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে  হরদেব মিশ্র মায়ের পুজোর ভার নেন। হরদেবের মৃত্যুর পর তাঁর ভাগ্নে নিমতলার জমিদার মাধবচন্দ্র  বন্দোপাধ্যায় উত্তরাধিকারসূত্রে এই মন্দিরের সেবায়েতের ভার পান। মাধবচন্দ্রের মৃত্যুর পর শিবকৃষ্ণ  বন্দোপাধ্যায় মায়ের সেবার দায়িত্ব পান। সেই থেকে বন্দোপাধ্যায় পরিবার মন্দিরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। আনন্দময়ী কালী মন্দিরে প্রতি দিন নিত্য পুজো হয়। প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়। কার্তিক অমাবস্যায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে কালী পুজো হয়।

এখন যেখানে আনন্দময়ী কালী মন্দির, আগে নিমতলা শ্মশান ঘাট ওখানেই ছিল। শ্মশানের মধ্যে কালী ছিলেন তাই তিনি শ্মশান কালী। পাশেই ছিল গঙ্গা। তারপর স্ট্যান্ড রোড তৈরি হতেই শ্মশান চলে গেল কালীমন্দিরের পশ্চিমে গঙ্গার ধারে। আনন্দময়ী ঘাটের কাছে একটি প্রকান্ড নিমগাছ ছিল, যে গাছ থেকে নিমতলা নামকরণ হয়েছে। নিমতলা ঘাট বলে বাঁধানো ঘাট জাতীয় কিছুই ছিল না। আনন্দময়ী তলাতেই শ্মশান ছিল। শ্মশান তৈরি হয় ১৮২৮ সালে এবং ১৮২৮ সালের ১৭ মার্চ থেকে এখানে শবদাহ আরম্ভ হয়।

এখানে ধর্মের মেলবন্ধন চাক্ষুষ করা যায়। আনন্দময়ী কালী মন্দিরের আগেই বাঁদিকে পড়বে একটি নয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ, নাম নিয়ামৎউল্লাহ মসজিদ। স্থানীয় জমিদার মহম্মদ রমজান আলি তাঁর পূর্বপুরুষ নিয়ামৎতুল্লাহ্র নামে ১৭৮৪ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। রমজান আলির পূর্বপুরুষ নিয়ামৎতুল্লাহ একটি ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই ঘাটের ধারেই তৈরি হয় মসজিদ। এই ঘাট নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কিংবদন্তি রয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম, দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এই ঘাট ব্যবহার করতেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...