মুড়ি: রাঢ়-বাঁকুড়ার নারীদের হেঁশেল ও জীবিকায়

বুড়ি ভুনগি-কে চেনেন? সেই যে প্রেমচন্দের ‘বিধ্বংস’ গল্পের বুড়িটা, যার পেশা ছিল লোকের মুড়ি ভেজে দেওয়া? ভুনগিকে না-চিনলেও, তার পেশাটাকে আপনাদের অনেকেই হয়তো চেনেন। আসলে, শুধু হিন্দিবলয়ের ভুনগি নয়, আমাদের রাঢ়-বাঁকুড়ার প্রায় সব গ্রামেই একদা এমন দু’একজন অভাবী সংসারের মহিলা ছিলেন, যাঁরা লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অথবা নিজের বাড়িতেই অন্যের জন্য মুড়ি ভেজে দিতেন। সে ছিল এক হাপিত্যেশের জীবিকা। সেই জীবিকার নাম ছিল, ‘ভাচাভানা’ বা ‘ভাজাভানা’। হাল আমলে গাঁয়ের আগায়-মাথায় মুড়ি ভাজার কল বসেছে। গেরস্তের হেঁশেলঘরে ভাজার রেওয়াজ এখন বন্ধ। প্রায় হারিয়েই গিয়েছে আজ ‘ভাচাভানা’ জীবিকা।

Muri-making-body

বলছি বছর তিরিশ আগের কথা। তখন মুড়ি ভাজার জন্য ভাচাভানাদের চাল দিতে হত, জ্বালানি দিতে হত। গেরস্তের যার যেমন মুড়ির পরিমাণ, সেই হিসেবে ভাচাভানারা তাদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক বা 'বানী' নিতেন। কেউ নিতেন ভাতের চাল, কেউ নিতেন ধান। নগদ টাকাপয়সা নেওয়ার তেমন চল ছিল না। অভাবের সংসারে ভাতের সংস্থান করতেই তো তাঁদের এই পেশাকে বেছে নেওয়া। তাই চাল নেওয়ার চলই ছিল বেশি। কারণ, তাতে কোন ঝঞ্ঝাট ছাড়াই ভাত করে নেওয়া যায়। আর ভাতটুকু জুটলে নুন দিয়েও খাওয়া যায়! 

'ভাচাভানা' পেশাটি শেষ হয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের জীবনযাত্রাগত সমৃদ্ধির কোন অবদান নেই। কর্মহীনতা এখনও অনেক দোরেই। শুধু ভাচাভানাদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ হয়ে গেছে। মুড়ি ভাজানো বন্ধ হয় নি। মেয়েদের হাত থেকে ভাজার কাজ ছিনিয়ে নিয়েছে পুরুষেরা। মুড়ির কল বসিয়ে। মানুষিক শক্তি বনাম মেশিন শক্তির যুদ্ধে মানুষী হেরে গেছে।

Muri-making-body-1

খুব বেশি দিন নয়; এই তো খানকতক বছর আগেও ফি হপ্তায় রমরমিয়ে মুড়ি ভাজা হত বাড়িতে। কিন্তু, এ বড় কষ্টের কাজ। প্রয়োজন হত দীর্ঘ প্রস্তুতির। ধান সেদ্ধ করে মুড়ির চাল তৈরির সময় থেকেই আলাদা করে তার তরিবত করতে হত। মুড়ির চাল তৈরির জন্য ধান সেদ্ধ করতে হত বার দুয়েক। প্রথমবার সেদ্ধ করতে হত ধান সামান্য ফাটা ফাটা হওয়া পর্যন্ত। তারপর সারারাত ঠাণ্ডা জলে তাদের ভিজিয়ে রাখা হত। ঠাণ্ডা জলে ঠাণ্ডা হতেই ফাটা অংশ বুজে গিয়ে প্রতিটি ধান হয়ে উঠত যেন একেবারে আনকোরা। পরদিন অবশ্য আবার সেদ্ধ করা হত তাদের, পুরোপুরি ফেটে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর তাদের মেলে দেওয়া হত খোলা আকাশের নীচে গনগনে রোদে।  শুকানো হত যদ্দিন না পুরো খটখটে হয়ে যায়। ধান থেকে চাল বার করে চিবোলে চাল যখন মসৃণভাবে গুঁড়ো হয়ে যেত, তখনই বোঝা যেত ভাঙানোর জন্য ধান একেবারে প্রস্তুত। তখন ঢেঁকিশালে ঢেঁকিতে পার দিয়ে কিংবা ধান ভাঙানো কলে নিয়ে গিয়ে ভাঙিয়ে নিলেই হল।

Muri-making-body-2

চাল তো না-হয় তৈরি হল। কিন্তু, তাই দিয়ে মুড়ি ভাজার আগে তরিবতের আরও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হত। সাধারণত বিকেল বেলা ধুচুনিতে চাল নিয়ে তাদের গায়ে লেগে থাকা তুষটুষ ভালো করে রগড়ে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নেওয়া হত। তারপর তাতে মেশানো হত স্বাদ মতো নুন। একে বলা হত, 'নুন খাওয়ানো'। পরিমাণমতো নুন যেমন মুড়ির স্বাদ বাড়াত, তেমনি তার গুণে মুড়ি হত একেবারে পাঁপড়ের মতো মোলায়েম। একটি পাত্রে চাল নিয়ে তার ওপর নুন ছড়িয়ে হালকা জল ছিটিয়ে ভালো করে সমস্ত চাল দু'হাত দিয়ে ওপর-নীচ এপাশ-ওপাশ কয়েক মিনিট ডলে দিলেই 'নুন খাওয়ানো' হয়ে যেত। তারপর সারারাতের জন্য ঘরের বাতাস খাওয়াতে মেলে দেওয়া হত নুন মাখানো চাল। সকাল থেকে আবার সেই চাল রোদে মেলে রাখা হত ঝনঝনে শুকনো হওয়া অব্দি। মাঝে মাঝেই মেলা চালে ন্যাতা দেওয়ার মতো করে হাত বুলিয়ে এপিঠ-ওপিঠ ঘুরিয়ে দিতে হত, যাতে চাল তাড়াতাড়ি এবং ভালোভাবে শুকোয়। চাল মেলতেই শুরু হয়ে যেত চড়াই আর পায়রাদের খুঁটে-লুটে খাওয়ার হররা। তখন খড়ের কাকতাড়ুয়া নাচিয়ে, অহরহ 'হুরর্ হুস' শব্দ করে কত কাণ্ডই না করা হত ওদের তাড়াতে!

Muri-making-body-3

কাঠের উনুন ছাড়া মুড়ি ভাজা যায় না। কারণ, প্রয়োজন মতো যত ইচ্ছে তাপ বাড়ানো এবং কমানো একমাত্র কাঠের উনুনেই সম্ভব, তাই। উনুন জ্বালা হয়ে গেলেই উনুনে 'ভিয়ান' বা 'ভিয়েন' বসানোর কাজ। আগে কুমোরেরা ভিয়েন তৈরি করত। তাদের তৈরি ভিয়েন হচ্ছে, আংটা-বিহীন মাটির বড় কড়া। কিন্তু, এতে একটাই সমস্যা, তলাটা অল্পদিনেই যেত ফেটে। ভিয়েন ভর্তি চাল নিয়ে কাজের সময় হঠাৎ দুম করে ফেটে গেলে কী ঝকমারি হত একবার ভাবুন তো! তাই অনেকেই এ-কাজের জন্য ঢালাই লোহার মাঝারি মাপের কড়া ব্যবহার করতেন। যাই হোক, উনুনে এই ভিয়েন বসিয়ে সেটা গরম হলে, তাতে নুন খাওয়ানো চাল ঢেলে দিয়ে ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ ওপর-নীচ নেড়ে যেতে হত 'চাটু' দিয়ে। 'চাটু' হল কাঠের তৈরি নৌকো-দাঁড়ের চ্যাপ্টা ও ছোট সংস্করণ। চাটুর নাড়াচাড়া বন্ধ করলে ভিয়েনের নীচের চাল পুড়ে যাওয়ার এবং ভিয়েনের তলায় তা সেঁটে যাওয়ার ভয়। তাই নাড়াচাড়া চালিয়েই যেতে হত যতক্ষণ না চালের রঙ তামাটে হয়ে উঠছে, ততক্ষণ। চাল তামাটে হলেই উনুন থেকে ভিয়েন নামিয়ে নেওয়ার পালা।

ভিয়েন নামালে পরে উনুনে চাপানো হত মুড়ি ভাজার 'খোলা'। সুন্দরপানা মাটির 'খোলা' তৈরি করত কুমোরেরা। তাছাড়া অনেকেই খোদার উপর খোদকারি করে মাটির হাঁড়ির মুখটি কাস্তের ফলা দিয়ে ঠুকে ঠুকে কেটে ফেলে দিয়ে নীচের গোল অংশটিকে 'খোলা' হিসেবে ব্যবহার করতেন। হাঁড়িটি লম্বালম্বি কাটলে দুটি খোল পাওয়া যেত। অনেকে আবার এই দুটি খোলই 'খোলা' বানিয়ে ফেলতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি খোলাও কিনতে পাওয়া যেত। মাটির হোক বা ধাতুর, খোলা উনুনে চাপানোর পরই কয়েক মুঠো শুকনো বালি দেওয়াটাই ছিল প্রাথমিক কাজ। বালি যদি সাদা চকচকে নতুন হত, তবে তাতে সামান্য রসও থাকত। তাই চালের গায়ে এরা হামেশাই সেঁটে যেতে চাইত। মুড়িতেও লেগে থাকত। ফলে, মুড়ি ভাজা শেষ করে সে-সব ঝাড়াই-বাছাই করে নিকোতেই দিন কাবার হবার জোগাড় হত। একদিন মুড়ি ভাজলেই অবশ্য এই বালি পুড়ে কালো হয়ে যেত, তখন আর খুব একটা এরা চালের গায়ে লাগত না। 

খোলার বালি গরম হয়ে গেলেই এক মুঠো চাল ভিয়েন থেকে নিয়ে তাতে ছেড়ে দিলেই তা পটাপট শব্দ তুলে ফুটতে শুরু করত। অমনি তাদের এপিঠ-ওপিঠ উল্টে ভালো করে ভেজে সজনে ফুলের মতো তুলতুলে করে তুলতে এক গোছা কাঠি ডান হাতের পাঁচ আঙুলের বিশেষ কায়দায় পাতলা করে ধরে নাড়তে হত। এবং, খোলার সব চাল মুড়ি হয়ে গেলে এই কাঠি দিয়েই খোলার পেটের ভেতর থেকে সবকটাকে টেনে উনুনের সামনের তকতকে মেঝেতে ফেলতে হত। এভাবেই শুরু হয়ে যেত মুড়ি ভাজার কারুকাজ।

Muri-making-body-4

মুড়ি ভাজার কাঠি তৈরি হত তিনরকমভাবে। প্রথমত, ঝাঁটার কাঠির মতো ফালি ফালি করে কাটা বাঁশ দিয়ে। এই কাঠি তৈরি করতেন ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা নিজেদের তৈরি বাঁশের ঝুড়ি-কুলো-ঝাঁটার সঙ্গে এই কাঠিও গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরি করে বিক্রি করতেন। দ্বিতীয়ত, নারকেল পাতার শির কেটে যে অংশটি দিয়ে খ্যাংরা ঝাঁটা বানানো হয়, তাই দিয়ে। যাঁদের বাড়িতে নারকেল গাছ আছে, সেই বাড়ির মেয়েরা নিজেরাই এ-ধরনের কাঠি বানিয়ে নিতেন। তৃতীয়ত, 'লুকুই' নামের এক ধরনের ঘাসের কাঠি দিয়ে। মাঠ, টাঁড় ও জঙ্গল থেকে এই ঘাসের কাঠি সংগ্রহ করতেন স্থানীয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাঁরা এই কাঠি দিয়ে ঝাঁটাও বানাতেন। তাই ঝাঁটার পাশাপাশি গোছা গোছা কাঠিও তাঁরা গাঁয়ে গাঁয়ে বিক্রি করতেন মুড়ি ভাজার জন্য। তবে, এই তিন ধরনের কাঠির মধ্যে বাঁশের কাঠিই সবচেয়ে ভালো ছিল। এগুলো পুড়ত কম। তাই এর পোড়া অংশ ভেঙে মুড়ির সঙ্গে মিশে মুড়ি নোংরাও হত খুব কম। সব ধরনের মুড়ি ভাজার কাঠিকেই 'কুচি' নামে ডাকা হত। কারণ, রাঢ়-বাঁকুড়ার ভাষায় 'কুচি' আসলে 'কাঠি'রই সমার্থক।

খোলায় প্রতি বার এক এক মুঠোর বেশি চাল ভাজা যায় না। তাই এক ভিয়েন চালের মুড়ি ভাজতে কমসে কম চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লেগেই যেত। আমাদের মা-মাসিরা সেই কোন ভোরে মুড়ি ভাজতে বসে একা হাতে ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে আগুন-খোলা-চালের সঙ্গে এক বেলা প্রাণান্তকর লড়াই চালাতেন। গরমকালে এই লড়াই ছিল আরও কঠিন। তবু মুড়ি না-ভেজে তাঁদের উপায় ছিল না। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে বিকেলের জলখাবার, এমনকি রাত্রে রুটি খাবার পর শেষ পাতে চাট্টি মুড়ি খেতেন বাড়ির প্রায় সকলেই। এক ভিয়েন চালের মুড়ি দিন সাতেকের মধ্যেই হাপিস হয়ে যেত। ফলে, নৈমিত্তিক লড়াই ছিল অনিবার্য। মুড়ি ভেজে ফেললেই তাঁদের কাজ শেষ হয়ে যেত না, পড়ে থাকত অক্লান্ত নিবিষ্ট হাতের আরও একটি কাজ। বড় একটা বাঁশের চালুনিতে হাতের হালকা চাপে ঘষে ঘষে সদ্য ভাজা মুড়ি চালতে হত তাঁদের। এভাবেই মুড়ির গায়ে লেগে থাকা বালি, পোড়া কাঠির টুকরো, পুড়ে যাওয়া মুড়ি, অপ্রস্ফুটিত মুড়ি সব চালুনির ফাঁক দিয়ে ফেলে ভালো মুড়ি আলাদা করে ফেলতেন তাঁরা। তারপর ঝকঝকে তকতকে মুড়িগুলো টিন বা প্লাস্টিকের ডাব্বায় কিংবা ত্রিপল বা প্লাস্টিক চাদরের বস্তায় ভরে মুখটি শক্ত করে এঁটে দিতেন। তাতেই মুড়ি তাজা থাকত বহুদিন।

সেই সব মা-মাসি-ভাচাভানাদের দিন 'হাঁটি হাঁটি পা পা' করতে করতে হঠাৎ এক ছুট্টে কোথায় চলে গেছে! আজ আর পুরো একটি বেলার প্রাণান্তকর লড়াইয়ের ঝঞ্ঝাট নেই। বাজারে দেদার কিনতে পাওয়া যায় রেডিমেড মুড়ির চাল। শুধু ধুয়ে নুন খাইয়ে শুকিয়ে বাড়ির পাশের মুড়ি কলে পাঠিয়ে দিলেই হল। মিনিট কুড়িতেই বস্তাভর্তি মুড়ি। কুমোর পাড়া আর মুড়ি ভাজার ভিয়েন বা খোলা বানায় না। ছুতোর চাল নাড়ার চাটু বানায় না। ডোম বা সাঁওতালরাও আর কুচি-কাঠি বেচতে আসেন না। চর্চা গেছে, চর্যা গেছে, শ্রম বেঁচেছে। লোকজীবন বদলে গেছে, আর বদলে গেছে ঘরগেরস্তের সেই তুলতুলে নরম নির্ভেজাল মুড়ির অমলিন মিষ্টি স্বাদ..

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...