রামপ্রসাদ লিখে গিয়েছেন,
'মুক্ত কর মা মুক্তকেশী।
ভবে যন্ত্রণা পাই দিবানিশি।।'
দেবী কালিকার রূপ অনির্বচনীয়। কালকে ধারণকারী কালী মুক্তস্বভাবা, তাই তিনি মুক্তকেশী। দক্ষিণাকালী, কালো রূপে দিগম্বরী শ্যামা মা। দক্ষিণাকালীই কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ রূপ। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। খোলা চুলের এই দেবীই মুক্তকেশী কালী।
গঙ্গার দুই তটে দুই মুক্তকেশী রয়েছে। আড়িয়াহদের মুক্তকেশীর কথা লিখেছি বহু আগে। এবার উত্তরপাড়ার মা মুক্তকেশীর কাহিনি জানাবো। একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি আগে উত্তরপাড়ার মুক্তকেশী গঙ্গার ঘাটে মুক্তকেশী মায়ের মন্দির গড়ে তোলেন।
দেবী মুক্তকেশীর সঙ্গে ভবতারিণীর রূপের বহু মিল আছে। ভক্তরা অনেকেই দেবী মুক্তকেশীকে ভবতারিণীর সখী, এমনকি বোনও বলে থাকেন। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবী মুক্তকেশী গঙ্গার ওপারে ভবতারিণীর সঙ্গে দেখা করতে যান। ভক্তদের অনেকেই দাবি করেন, ভোরবেলায় এক লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা বধূকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘাটে নামতে দেখেছেন। তারপর আর তাঁকে দেখা যায় না। ঘাটটির নামও দেবীর নামে মুক্তকেশী ঘাট।
এই মন্দির অত্যন্ত জাগ্রত, মনস্কামনা জানালেই পূরণ হয়। বহু ভক্ত এখানে মনস্কামনা পূরণের জন্য আসেন। মন্দিরের ডানদিকে রয়েছে কষ্টিপাথরের বিশাল আকারের শিলা। সেই শিলায় প্রতিদিন ফুল, বেলপাতা ও সিঁদুরের দিয়ে পুজো করা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই শিলাই নাকি দেবী মুক্তকেশীর আগের রূপ। মন্দিরের সেবায়েত মজুমদারদের কোনও এক সদস্যকে দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, ডাকাতের হাত থেকে বিগ্রহ বাঁচানোর জন্য। কারণ, ডাকাতরা নাকি দেবীর বিগ্রহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। দেবীর বিগ্রহ বালি খালের পূর্ব পাড়ে ভেসে এসেছিল। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে আসার জন্যই স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন দেবী।
স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, বালি খালের পূর্ব পাড়ের ঘাটে দেবীর শিলা বিগ্রহের দেখা মিলেছিল। শিলারূপী বিগ্রহকে মন্দিরে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। দেবী স্বপ্নাদেশে বলেছিলেন, কষ্টিপাথরের শিলায় যেন কোনও ছেনি-হাতুড়ির স্পর্শ না করা হয়। শিলাকে যেন অবিকৃত রূপেই পুজো করা হয়। দেবী হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন কেউ যদি শিলায় হাতুড়ি ঘা মারেন, তাঁর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর দেবীর অন্য একটি কষ্টিপাথরের মূর্তি মন্দিরে বিগ্রহ হিসাবে আনা হয়। শিলার পাশাপাশি সেই কষ্টিপাথরের মূর্তিরও পুজো চলে দেবী মুক্তকেশীর মন্দিরে।
একটি মতে, আনুমানিক ১৮৮২ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। জানা যায়, মায়ের প্রাচীন মাটির মন্দির অনেক আগেই গঙ্গাগর্ভে বিগ্ৰহ-সহ বিলীন হয়ে গিয়েছিল।১৩১৪ সালের ১৪ মাঘ, ইংরেজির ১৯০৭ সালে মন্দির আর কষ্টিপাথরের মা মুক্তকেশীর প্রতিষ্ঠা করেন অনুকূলচন্দ্র মজুমদার। দক্ষিণমুখী দালানরীতির সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দির, মূল মন্দিরের প্রবেশপথে রয়েছে নাটমন্দির। গর্ভগৃহের বিরাজ করেন দেবী। পাথরের বেদিতে শায়িত মহাদেবের বুকে দাঁড়িয়ে মা মুক্তকেশী। সম্পূর্ণ কষ্টিপাথরের দেবীর উচ্চতা দু-ফুট। মাথায় রূপোর মুকুট। নাকে সোনার নথ। পিছনে পিতলের চালচিত্র। পাশে বয়ে চলে গঙ্গা।
নাটমন্দিরের গায়ে ফলকে লেখা—
গ্রামীণ প্রাচীন দেবী
শ্রীশ্রীমুক্তোকেশী কালীমন্দির
উত্তরপাড়া, হুগলী।
মন্দিরে দেবীর সঙ্গে রয়েছেন মহাদেব ও গণেশ। শিলা খণ্ডের সামনে প্রাচীন ঘটে প্রতিদিন তেল, সিঁদুর দেওয়া হয়। দেবী মুক্তকেশীর সঙ্গে এই মন্দিরে জগন্নাথের পুজোও করা হয়। মন্দিরে সরস্বতী পুজো, প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো, দীপান্বিতায় কালী পুজো, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা, রথয়াত্রা-সহ বিশেষ তিথিতে দেবীর আরাধনা হয়। দেবীকে এই মন্দিরে অন্নভোগ দেওয়া হয়। বিশেষ তিথিতে চলে খিচুড়ি ভোগ। এখনও বলিদান হয়। জৈষ্ঠ্যমাসের অমাবস্যায় হয় মায়ের উৎসব।