এক ব্যতিক্রমী কালী মূর্তি রয়েছে নদিয়ার কল্যাণীতে। কল্যাণীর কাটাগঞ্জে রয়েছে দেবী মৃত্যুনাশিনী কালীর মন্দির। ছোট পাড়া বুড়িবটতলার এই মন্দিরের বয়স ৭৫ বছর। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হলেও মায়ের পুজো শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে। তখন কাটাগঞ্জ অবশ্য এমন ছিল না। এক সাধিকা দেবীর সাধনা করতেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি সাধিকা মা নামে পরিচিতা ছিলেন। তিনি দেবীকে মেয়ে মনে করতেন। বেটি বলে ডাকতেন।
সাধিকার মৃত্যুর পর, তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয় মন্দিরের পাশে। ওই সিদ্ধ যোগিনী চেয়েছিলেন দেবীর বেদির নীচেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হোক। কিন্তু সেই ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেননি ভক্তরা। সাধিকার বিয়ে হয়েছিল রাজপরিবার। স্বামী ছিলেন মাধবানন্দ ব্রহ্মচারী। তিনি বিয়ের পরদিনই গৃহত্যাগী হন। স্বামীর মত ও পথ তাঁর সহধর্মিণীর পছন্দ হয়, সমাজকে উপেক্ষা করে তিনিও গৃহত্যাগ করেন। ভাগীরথীর তীরে এসে বসেছিলেন, তখন ভাগীরথী প্রবহমান ছিল। কালের নিয়মে আজ ভাগীরথী পথ পরিবর্তন করেছে। ভাগীরথীর তীরে বসে থাকার সময় সাধিকা মা ভাসমান ঘট দেখতে পান। লোকমুখে শোনা যায়, এরপরই মায়ের আদেশে ঘটটি জল থেকে তুলে এনে পার্শ্ববর্তী বট গাছের তলায় খোলা আকাশের নীচে বসে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন এবং স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীর মূর্তি তৈরি করে মায়ের পুজো-অর্চনা শুরু করেন। প্রতি বছর মাতৃ মূর্তি অঙ্গরাগ করা হয়। মায়ের মূর্তিতে কোনও প্রকার ক্ষত দেখা দিলে তা পরিবর্তন করার আদেশ রয়েছে। আদেশ সাধিকা মা-ই ভক্তদের দিয়ে গিয়েছেন।
কাটাগঞ্জে পরবর্তীতে একটু একটু করে বসতি স্থাপন শুরু হয়। প্রথমে খড়ের ছাউনি দিয়ে ছোট্ট একটি মন্দির গড়া হয়। তা আগুনে পুড়ে যায়, পুনরায় মাটি দিয়ে আর একটি ঘর তৈরি করে তাতে মাতৃআরাধনা করা শুরু করেন সাধিকা মা।
মন্দির ঘিরে অলৌকিক ঘটনার শেষ নেই। অসুস্থ রোগী সুস্থ হয়ে যেত, রোগ থেকে মুক্তি, বেকারের চাকরি হওয়া, নিঃসন্তানের সন্তানলাভ ইত্যাদি হয় দেবীর কৃপায়। মন্দিরে একবার মাঘী পূর্ণিমার দিন ভোগ রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সময় সাধিকা মা বলেন বট গাছের ডাল জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করো। বট গাছে কোনো শুকনো ডাল ছিল না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সবুজ বট গাছের মধ্যে শুকনো ডালের দেখা মেলে। একদা বালক সেবার জন্য কোনও খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায়নি, তখন মায়ের আদেশে খালি হাঁড়িতে জল ফোটাতে দিলে কিছুক্ষণ পর দেখা যায় হাঁড়িতে চাল-ডাল ফুটছে। ইত্যাদি নানান অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এ মন্দির।
মায়ের রূপ এখানে একেবারে আলাদা। দেবী মূর্তি ত্রিমস্তক যুক্ত। গাত্রবর্ণ শ্বেতশুভ্র। মা ষড়ভুজা, ওপরের ডান হাতে খড়্গ, ওপরের বাম হাতে খড়্গ। নীচের বাম হাতে নরমুণ্ড, বাকি হাতটি বরাভয়দায়িনী। পদতলে শিব। এছাড়াও পাশে শিব মূর্তিও পূজিত হয় মন্দিরে। মাতৃমূর্তির পাশে রয়েছেন মায়ের ভৈরব, ভৈরবের নাম কপাল ভৈরব। মায়ের নিত্যভোগে চিঁড়ে, বাতাসা, কিশমিশ, কাজু নিবেদন করা হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস মাঘী পূর্ণিমাতে। পয়লা বৈশাখে এখানে মেলার বসে। ভক্তরা আসেন।