বাংলার কালী মন্দিরদের নিয়েই কালীকথার সফর, এ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কালী মন্দির। সেগুলোকে ঘিরে রয়েছে হাজারও ইতিহাস। রয়েছে বহু জনশ্রুতি, মিথ, কাহিনি। ধাপে ধাপে সে'সব হাজির করা হচ্ছে। আজ আরও এক প্রাচীন কালী মন্দিরের গল্প। বয়সে বেশি প্রবীণ, তবে নির্দিষ্ট করে সময়কাল জানা যায় না। অনুমান করা হয়, মন্দিরটির বয়স দু'শো বছরের কাছাকাছি হবে। যুগ যুগ ধরে মানুষ ছুটে যাচ্ছে এই মন্দিরে। মন্দিরটি রয়েছে উলুবেড়িয়ার ধূলাসিমলায়। মন্দিরটি মৌবেশিয়া কালী মন্দির নামে পরিচিত। এ মন্দির ঘিরে রয়েছে একাধিক রহস্য, গল্প। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সিপাই বিদ্রোহ অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের বহু আগে মৌবেশিয়া গ্রামে দেবী কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আন্দুলের মহারাজা। একদা মাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে পাকা মন্দির গড়ে তোলা হয়। মৌবেশিয়ার মায়ের নাম অনুসারে গ্রামের নাম মৌবেশিয়া কালীতলা হয়েছে।
ভক্তদের মতে, মৌবেশিয়া কালীতলার দেবী কালী খুবই জাগ্রত। কথিত আছে, দেবী নাকি ভোররাতে মন্দির থেকে পায়ে হেঁটে নারায়ণের মন্দিরে যেতেন। রাতে মায়ের পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যেত। এ মন্দির ঘিরে এমন কাহিনির অন্ত নেই। জনশ্রুতি রয়েছে, কোনও এককালে মন্দিরের সামনে কালীর দায়িত্বে ধানের বস্তা রেখে চাষীরা বাড়ি চলে গিয়েছিল। সেই রাতে চোর আসে। ধান চুরি করতে যাওয়ার সময় বস্তা তার গায়ে ফেলে দেন মা। চোর পালাতে না পেরে, ধরা পড়ে যায়।
পরাধীন যুগে বিপ্লবীরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে তাঁরা মন্দিরে পুজো দিতেন। নিজ দেহের রক্তে তাঁরা পুজো দিতেন দেবীর। অস্ত্র মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে, তারপর দেহের রক্তের তিলক কাটতেন কপালে। তারপর যোগ দিতেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে। মৌবেশিয়া মন্দিরে মায়ের ছিল মূর্তি ভয়ঙ্করী। দিনের বেলায়ও ভয়ে মন্দিরের ধারেকাছে আসতেন না মানুষজন। পরবর্তীতে মূর্তি বদল করা হয়।
মন্দিরে বলিদানের রেওয়াজ ছিল, প্রতি অমাবস্যায় বলি হত। এখন বলি প্রথা বন্ধ। মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়। মৌবেশিয়া গ্রামে যেকোনও ধরনের শুভ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে কালীর কাছে পুজো দেওয়ার রেওয়া রয়েছে।
কার্তিক মাসে মৌবেশিয়া কালী তলায় এক উৎসব আয়োজিত হয়। কার্তিক মাস, দামোদর মাস হিসেবে পরিচিত। ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে কার্তিক মাসের গুরুত্ব অসীম। এই সময় অনেকেই নানান ব্রত, নিয়ম পালন করেন। তাই এই মাস ত্যাগের মাস হিসেবেও পরিচিত। এই মাসে মন্দিরে বা বাড়িতে ভাগবানের উদ্দেশ্যে দীপদানের রীতি রয়েছে। বলা ভাল, দীপদান এই মাসের অন্যতম একটি উৎসব। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আকাশ প্রদীপ দেওয়া হয়। লক্ষ্মী পূর্ণিমা থেকে রাস পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রদীপ দান এবং নগর সংকীর্তন চলে। উলুবেড়িয়ার মৌবেশিয়া কালীতলাতে দীপদান উৎসব পালিত হয় মহাসমারোহে। প্রচুর সংখ্যায় ভক্ত সমাগম হয়। কালী পুজোর সন্ধ্যায় মৌবেশিয়া কালীতলার নারায়ণ মন্দিরে মাটির প্রদীপ হাতে ভক্তরা দীপদান উৎসবে অংশ নেন।২০০৯ সাল থেকে এই উৎসব পালিত হচ্ছে মৌবেশিয়ায়। ফি বছর দীপদানের পাশাপাশি নগর সংকীর্তন চলে। রাস পূর্ণিমার দিন এই উৎসব বড় আকার নেয়। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর ভক্ত উৎসবে যোগ দেন।