কালী হলেন শ্মশানবাসিনী, তিনি মৃত্যুর দেবী। শ্মশানে, জঙ্গলে, আড়ালে তান্ত্রিকেরা তাঁর পুজো করতেন। মৃত্যুর দেবী ধীরে ধীরে বাংলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা হয়েছেন, এ কৃতিত্ব পুরোপুরি মধ্যেযুগের বঙ্গের সাধক, পদকর্তাদের। কিন্তু আজও বাংলার নানান প্রান্তে শ্মশানকালীর পুজো হয়। তেমনই এক বিখ্যাত শ্মশানকালী হলেন মহিন্দর গ্রামের কালী। দেবী প্রায় তিনশো-চারশো বছর যাবৎ পূজিতা হচ্ছেন এই গ্রামে। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরে রয়েছে মহিন্দর গ্রাম। সেই গ্রামের শ্মশান দেবীর পুজো হয় চৈত্র মাসে। ফি বছর ১৬ চৈত্র মায়ের বার্ষিক পুজো হয়। এক রাতের এই কালী পুজোয় উপচে পড়ে ভিড়। একদা নির্জনে, আড়ালে শ্মশানে মায়ের পুজো হত। এখন এই পুজোকে কেন্দ্র করে এক রাতে কয়েক লক্ষ লোক জমা হয়। এলাকার মেয়েরা, যাঁদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তাঁরা বাপের বাড়ি আসেন। যাঁরা বাইরে থাকেন কর্মসূত্রে, তাঁরাও ফিরে আসেন।
এখন পুজো উপলক্ষ্যে গোটা মহিন্দর আলোয় সেজে ওঠে, চন্দননগরের আলোক সজ্জায় সাজিয়ে তোলা হয় গোটা গ্রাম। মেলা বসে। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই শ্মশান কালীর পুজো?
জনশ্রুতি অনুযায়ী, মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই শুরু হয়েছিল দেবীর পুজো, রায়নার সভাকরদের হাতেই শুরু হয়েছিল দেবীর পুজো। একবার কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। সে সময় কোনও এক গ্রামবাসী দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। সেই মতো পুজো করা হয়। তারপরই রোগ মুক্তি ঘটে। সেই থেকে হয়ে চলেছে দেবীর আরাধনা। তবে প্রথমে কোনও ব্রাহ্মণ শ্মশানে শ্মশানকালীর পুজো করতে রাজি হননি। রায়না গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের কোনও এক পুরুষ প্রথম মায়ের পুজো করেন। সেই তখন থেকেই বংশ পরম্পরায় মায়ের পুজো দায়িত্ব পালন করে আসছে ভট্টাচার্য পরিবার। তাঁরা মাকে নিজেদের বাড়ির অধিষ্ঠাত্রী দেবী রাজেশ্বরী রূপে পুজো করেন।
পুজোর নিয়মকানুনে রয়েছে বহু বিশেষত্ব। বার্ষিক পুজোর দিন সূর্যাস্তের দেবীর মূর্তি গড়া শুরু হয়। আড়াই কোদাল মাটি দিয়ে তৈরি হয় দেবীর মূর্তি। মৃন্ময়ী মা। তিনি মোদো কালী নামেও লোকমুখে পরিচিত। মাটির সঙ্গে হাঁসের ডিম আর মদ মিশিয়ে মায়ের মূর্তি গড়া হয়। সন্ধ্যায় মা মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপ ধারণ করেন। দেবীর গাত্রবর্ণ অমাবস্যার রাতের মতো কালো। মা শ্মশানবাসিনী। মায়ের নেত্র রক্তপিঙ্গলবর্ণ, তাঁর কেশ মুক্ত, তাঁর দেহ চামুণ্ডার মত, অতি ভৈরবা শুষ্কমাংসা। তাঁর বাম হাতে মদ্য-মাংসপূর্ণ পাত্র এবং ডান হাতে নরমুণ্ড। দেবী হাস্যবদনা এবং মাংস চর্বণ করছেন। দেবী নানা অলঙ্কার ধারণ করেন এবং তিনি দিগবসনা। উচ্চতা মোটামুটি আড়াই থেকে তিন ফুট।
মায়ের মূর্তি তৈরি হয় জোড়া মন্দির তলার দুর্গা মন্দিরে। তারপর সেখান থেকে মাকে নিয়ে আসা হয় পুজোর স্থানে। খোলা আকাশের নীচে দেবীর পুজো হয়। দেবী কালী ভক্তদের মাথায় চড়ে নাচতে নাচতে বিশাল বর্ণাঢ্য শোভযাত্রার মাধ্যমে শ্মশানে আসেন। শ্মশানের চিতা কুণ্ডের পাশেই তৈরি হয় দেবীর দেবী। এত ভিড় হয় যে এক কিলোমিটার রাস্তা আসতে সময় লেগে যায় তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা। সারা রাত ধরে নানান উপাচারে পূজিতা হন মা। জেলেদের ধরা মাছ পুড়িয়ে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই নির্দিষ্ট পুকুর থেকে ধরা মাছ দেবীকে নিবেদন করা হচ্ছে। একবার জাল ফেলে যে মাছ ওঠে, তাই-ই দেবীকে দেওয়া হয়।
সারা রাত ধরে পুজো হওয়ার পর আসে মায়ের বিদায়ের পালা, সূর্যোদয়ের মা বিদায় নেন। মায়ের সঙ্গে কেবল মাত্র দুজনই যেতে পারেন, তাও গ্রামের কেউ যেতে পারেন না। মায়ের বিসর্জন হয় না সেই অর্থে। মহিন্দর থেকে পাশের গ্রাম দোগাছিয়ায় মায়ের মূর্তি মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর দোগাছিয়ায় এক পুকুর, তালপুকুর পাড়ে; জলের পাশেই মাকে নামিয়ে রাখা হয়। তারপর আর কেউ পিছন ফিরে দেখেন না। যাঁরা মাকে নিয়ে যান, তাঁরা অন্য রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মায়ের মূর্তি নামিয়ে রাখার পর আর কেউ কখনও মা কে দেখেননি, শোনা যায় মা নিজেই হেঁটে পুকুরে নেমে যান। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী খুবই জাগ্রত। এক্ককালে ভয়ে যে পুজো মানুষ যেত না, আজ সেই পুজো উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হচ্ছে, হয়ত এটিই মহিন্দরের মায়ের মাহাত্ম্য।