টাকার আঁতুড়ঘরের ইতিবৃত্ত

                          মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য উপাদান  হলো মুদ্রা।  প্রত্নতাত্বিক উপাদানের অন্যতম এটি। আর এই  মুদ্রার জন্মস্থান হলো মিন্ট বা টাঁকশাল। কিন্তু এই মুদ্রার ধারণা আজ নয় - এসেছিলো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে - নাম ছিল পাঞ্চড মার্ক কয়েন। তার নির্দিষ্ট কোনো আকার না থাকলেও বাণিজ্যিক কার্যকরিতার জন্য তা ছিল যুগোপযোগী এবং বিপুল তথ্যবাহী সেই শুরু। তারপর বিবর্তন। প্রাচীন যুগের  ইতিহাস হোক বা সুলতানি- মুঘল যুগ -আধুনিক যুগ - মুদ্রা সব সময়েই ইতিহাসের সমৃদ্ধশালী  আকর। ইতিহাস রচনা ও পুনর্গঠনে মুদ্রার ভূমিকা অপরিসীম। ধাতু বিজ্ঞান বা মেট্রোলজি আর ইতিহাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন আছে। আজ সেই কথাই বলবো।

ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রথম মিন্ট স্থাপিত হয় এই কলকাতায়। নবাব  সিরাজ ১৭৫৬ সালে কলকাতা  দখল করে এর নাম রাখেন আলিনগর। কিন্তু পরে লর্ড ক্লাইভের কাছে  পরাজিত হওয়ার পরে  একটি  সনদ স্বাক্ষরিত হয়, যার অন্যতম শর্ত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আলীনগর অর্থাৎ কলকাতায় টাঁকশাল স্থাপন করবে। যদিও পরবর্তীকালে এই সনদ মীরজাফর দ্বারা পুনর্নবীকরণ হয়।  এর ভিত্তিতেই  বর্তমান কলকাতার  জি. পি. . এর কাছে পুরোনো কেল্লার পাশে  ১৭৫৭ সালে প্রথম মিন্ট স্থাপিত হয় উৎপাদন শুরু হলো ‘সিক্কার, ইতিহাসের অন্যতম কলংকিত চরিত্র  জগৎ শেঠের তত্ত্বাবধানে। যদিও এখন আর এর কোনো চিহ্ন নেই। এখানে কাজের  জন্য শ্রমিক  আনা  হয় মুর্শিদাবাদ থেকে, মুদ্রা  বিশেষজ্ঞ আর যন্ত্র আসে ইউরোপ থেকে।  এখানে তৈরী প্রথম মুদ্রাটির ঠিকানা বোধহয় ব্রিটিশ মিউজিয়াম 

                                 ১৭৯০ সালে জিলেট শিপ বিল্ডিং এস্টাব্লিশমেন্টে কলকাতার দ্বিতীয় মিন্ট চালু হয় এই দুই মিন্টে মুদ্রিত কয়েনগুলো মুর্শিদাবাদী সিক্কা নামেই পরিচিত ছিল।  এর বেশ কিছুকাল পর  ১৮২৪ সালের মার্চ  মাসে  বর্তমান পোস্তা  এলাকায়  ৪৭ স্ট্র্যান্ড রোডে  কলকাতার তৃতীয় মিন্ট  স্থাপিত হলেও  ১৮২৯ সালের  ১লা আগস্ট  থেকে উৎপাদন শুরু হয়Old Silver Mint নামে খ্যাত এই মিন্ট সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, যে প্রিন্স দ্বারকানাথ শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে  ভবনটি ৪০ টি স্তম্ভবিশিষ্ট ও  এথেন্সের  পার্থেনন মন্দিরের  আদলেই  তৈরী  হয়। গঙ্গার পাড়ের পলিমাটির উপর নির্মিত হওয়ায় ভবনটির ভীত ছিল ২৫ ফুট গভীর।

 

                                 ১৮৩৫ পর্যন্ত  এখানে  মুর্শিদাবাদী  সিক্কাই উৎপাদিত হতো। দিনে ৩ -৬ লক্ষ মুদ্রা তৈরিতে সক্ষম এই মিন্ট ছিল  সমসাময়িক কালের  পৃথিবীর ব্যস্ততম মিন্ট ১৮৬০ এ  তাম্র মুদ্রার  বিশেষ উৎপাদনের জন্য  সিলভার মিন্টের উত্তরে কপার মিন্ট স্থাপিত হয়।  ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম স্থাপিত বোল্ট এন্ড ওয়াট কোম্পানির মেশিনে কাজ হতো এখানে। সোনা , রুপো , তাম্র মুদ্রা ছাড়া এখানে ব্রিটিশ সরকারের নানা পদকের মডেল তৈরী হতো। অবশেষে ১৯৫২ সালে আলিপুরে কলকাতার চতুর্থ তথা বর্তমান মিন্ট তৈরী হওয়ার  পর এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।  শেষে এটি সি.পি এফ এর ক্যাম্পে পরিণত হয়। ভগ্নদশা ভবনটি এখন একটি হেরিটেজ বিল্ডিং হওয়ার পথে। এখানে 'মিন্ট মিউজিয়াম' গড়ে তোলা সরকারের পরিকল্পনাধীন।

                         স্বাধীন ভারতের চালু হওয়া প্রথম মিন্ট - আলিপুর মিন্ট ১৯৩০ সালে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলেও বিশ্বযুদ্ধের  গোলমালে কাজ  শেষ হতে প্রায় ২০ বছর  সময় লাগে। ১৯৪২ সালে নির্মাণ কার্য শেষ হলেও  কলকাতা  পোর্টের  লিজ নেওয়া জমিতে ১৯৫২  সালের ১৯শে মার্চ অবশেষে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী  সিডি দেশমুখ কর্তৃক  এর উদ্বোধন  হয়। এটির স্থাপত্য যথেষ্ট নজর  কাড়া। ১৯৫০-১৯৫৭ সালে রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া  সিরিজে মুদ্রাগুলো প্রকাশিত হয়। প্রথম ডেসিমাল সিরিজ অর্থাৎ নয়া পয়সার মুদ্রণ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। ৩ পাইতে এক পয়সা। ৪ পয়সায় এক আনা, এই প্রাচীন পদ্ধতিতে টাকার মূল্যমান অপরিবর্তিত রেখে এক টাকার ১০০ ভাগের এক ভাগকে এক নয়া পয়সা ধরে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় মুদ্রা আইনে সংশোধনী এনে এই 'নয়া' শব্দের বিলুপ্তি সাধন করা হয়  যদিও স্মৃতিতে তার অস্তিত্ব  বেশ কিছুদিন  ছিল।  পুরোনো  চার আনা আর আট আনা যেহেতু যথাক্রমে পঁচিশ ও পঞ্চাশ নয়া পয়সার সমান ছিল তাই এদের ওই নামেই পরিচিতি ছিল বেশি। অর্থনীতির ফেরে এখনো তো পয়সার অবয়বগত অস্তিত্ব হয়েছে বিলুপ্ত। টাকাই এখন সম্বল।                             

                                                                                                      একসময়  ভুটান, সিকিমের মুদ্রাও  এখান থেকে রপ্তানি হতো। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই এখানেই প্রথম সফলভাবে খাঁটি নিকেল থেকে মুদ্রা বানানো হতো। এখানে বিভিন্ন সময়ে অজস্র কমমেমোরেটিভ কয়েন প্রকাশিত হয়েছে। ভারতরত্ন, পরমবীর চক্র, পদ্ম পুরস্কার ইত্যাদি এখানেই  তৈরী।  সারাদেশের মুদ্ৰাতত্ববিদরা  এখান থেকেই স্মারক মুদ্রা সংগ্রহ করেন।

                          কলকাতার বাইরে বোম্বে, হায়দ্রাবাদ, নাসিক, পশ্চিম  মেদিনীপুরের শালবনিতে মিন্ট আছে। কোথাও  হয় প্রুফ তৈরী কোথাও বা নোট। এগুলো সবই কেন্দ্রীয় সরকারের  অর্থ মন্ত্রকের অধীন।  অবিভক্ত ভারতের লাহোরেও একটি মিন্ট ছিল, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত। সে যাই হোক ক্রমশ ভবিষ্যত  এমন দিকে  যাচ্ছে যেখানে টাকার অস্তিত্বই শেষ কথা বলবে, ধাতব মুদ্রা নয়। তবে আপাতত টাঁকশাল থাকবে পুরোনো কলকাতার চিহ্ন হয়ে,  যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...