কালী কথা: মাটিয়া কালী, মাটির থানেই পূজিত হন দেবী কালিকা

আজ কালী কথায় দিনাজপুরের দুই কালীর কথা। দিনাজপুর ভাগ হয়ে দুই জেলা হয়, উত্তর ও দক্ষিণ। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত কালী মন্দির হল কুশমন্ডি ব্লকের আমিনপুরের 'মাটিয়া কালী' মন্দির। দীর্ঘ ৬০০ বছর ধরে এখানে দেবী কালিকার পুজো হয়ে আসছেন। পুজোর রীতিতে নিরাকার, সকার আরাধনা মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে।

দেবীর নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক রহস্য। মাটির থানেই দেবী কালিকার পুজো সম্পন্ন হয়। পুজো শেষ হতেই দেবী ফের মাটিতেই মিলিয়ে যান। এই কারণেই দেবী এখানে 'মাটিয়া কালী' নামেই পরিচিত। আজ থেকে ৬০০ বছর আগে জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই কালী পুজোর সূচনা করেন। জমিদার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। দেবীকে যোগেন্দ্রনারায়ণকে দর্শন দিয়ে বলেছিল, তিনি যেন মাতৃ আরাধনা আরম্ভ করেন। স্বপ্নাদেশেই দেবী যোগেন্দ্রনারায়ণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোনও মন্দির তৈরি করতে হবে না। সেই কারণেই অদ্যাবধি দেবীর কোনও মন্দির নেই। প্রাচীন রীতি মেনে আজও মাটির থানেই হয় দেবী কালিকা এই পুজো। 

কথিত রয়েছে, দেবী মাটিতে থাকার কারণে ওই সময় জমিদার বাড়ির সকলে নাকি মাটিতেই ঘুমোতেন। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় জমিদাররা রটন্তী কালী পুজো করে জয়লাভ করেছিল। সেই থেকেই দেবীর আরও মহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় রটন্তী কালী নামে পূজিতা হতেন দেবী। পরবর্তীতে মাটিতে থাকার কারণে রটন্তী কালী এলাকাবাসীর কাছে 'মাটিয়া কালী' নামে পরিচিত হন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মা সব মনোবাঞ্ছাপূরণ করেন। যেকোনও শুভ কাজ শুরু করার আগে তারা মায়ের পুজো দেন। স্থানীয়দের মধ্যে, মনোস্কামনা পূরণের জন্য 'মাটিয়া কালীর' থানের মাটি তুলে খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় এখানে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পুজো হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমান।

কালী রয়েছেন শিব তো থাকবেই। যেহেতু এখানে মূর্তি নেই, তাই অন্যত্র রয়েছে দেবাদীদেব। মা মাটিয়া কালীর থানের ঈশান কোণে ছিল একটি ছোট্ট ঘর৷ সেখানে এককালে মায়ের গহনা রাখা হত৷ তার পাশেই রয়েছে পঞ্চমুখী শিব৷ মায়ের মন্দির না থাকলেও পঞ্চমুখী শিবের জন্য মন্দির তৈরি করা হয়েছে। পাঁচমাথা শিবের চত্বরে সত্যিই বিরল৷ লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই পাঁচমাথা শিব মন্দিরের বয়স দুশো বছরেরও বেশি৷ শোনা যায়, এই শিব মন্দিরের সঙ্গেও ২১৭ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। সিংহ পরিবার অধুনা মন্দিরের দেখভাল করেন। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর থেকে বংশ পরম্পরায় তারাই পুজোর দেখাশোনা করি। 

দক্ষিণ দিনাজপুরের মাটিয়া কালী মায়ের মন্দির অত্যন্ত জাগ্রত, কালীপুজোর রাত্রে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের আগমন ঘটে। মাটিয়া কালী পুজাতে প্রাচীন রীতি মেনে আজও বলি প্রথা রয়েছে। পুজো উপলক্ষ্যে বহু বছর ধরে মেলা। জাগ্রত এই কালী মা যেহেতু মাটির থানেই পূজিত হন, সে কারণেই মেলায় আগত সকল দোকানদাররা মাটির উপর আসন পেতে বসে ব্যবসা করেন। দীপান্বিতা অমাবস্যায় মায়ের পুজোর সময় সবচেয়ে বেশি ভক্তদের সমাগম হয়। কথিত আছে, এক বার কোনও ভক্ত এই মন্দিরে এলে, আর অন্য কোনও কালী মন্দিরে যাওয়ার দরকার পড়ে না। এখানেই ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পুরণ হয়।​

উত্তরে রয়েছে বয়রা কালী। বয়রা গাছের নীচে গড়ে উঠেছে কালিকার মন্দির। তাই মা এখানে বয়রা কালী নামেই পরিচিত। উত্তরবঙ্গের ছোট জনপদ কালিয়াগঞ্জ। প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মা কালী এখানে পূজিত। এককালে এখানকার শ্রীমতি নদীতে বনিকেরা বাণিজ্য করতে আসত। জনশ্রুতি রয়েছে, ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যে আসা-যাওয়ার পথে পুজো দিয়ে যেতেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বয়রা গাছের তলায় মা কালীর মন্দির থাকায় ব্যবসায়ীরাই মায়ের নাম দিয়েছিলেন বয়রা কালীর মন্দির। নদী একদা মজে গেল, ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বন্ধ হল। এলাকা জঙ্গলে ঢেকে গেল। লোকের আনাগোনা কমতেই জঙ্গলে গড়ে উঠল ডাকাতদের ডেরা। ডাকাতরাই মায়ের পুজো দিতে আরম্ভ করলেন। পরবর্তীকালে ভক্তদের থেকে চাঁদা তুলে মায়ের অষ্টধাতু মূর্তি গড়ে পুজো শুরু হয়। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...